জুলাই ১৫, ২০২৫ ৭:১৭ এএম

স্কুলে যেতে না পারলেও পাশে নিয়ে আছে বই

প্রতিবাদ করায় শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থী শামীমার স্বপ্ন 

লোক লজ্জার ভয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে মোড়ানো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার। তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে, যাবে স্কুলে, সহপাঠীদের সাথে মেতে উঠবে আনন্দে। তবে স্কুলে যেতে না পারলেও পাশে নিয়ে আছে বই। পড়াশোনার নেশা যেন তাড়া করে ফিরছে তাকে। 

বলছি নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শামীমা আকতারের (১৪) নির্মমতার কথা। তিনি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খোজাগাড়ী গ্রামের শামীম হোসেনের মেয়ে। এবং স্থানীয় সন্যাসতলা নাসরিন সিদ্দিকী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। গত দুই মাস আগেও তার চোখে মুখে ছিল রঙিন স্বপ্ন। পড়াশোনা করে করবে চাকরি। ঘুচাবে বাবা-মার কষ্ট। কিন্তু সেই স্বপ্নে গুরে বালি। এখন বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে সুস্থ হওয়ার আশায়।

বাবা দিনমজুর হওয়ায় অভাব অনটনের সংসারে সুখ ফেরাতে মা হয়েছে প্রবাসী। অভাবের সংসারে শামীমা কষ্ট করে চালিয়ে যাচ্ছিল পড়াশুনা একদিন পরিবারের পাশে দাঁড়াবে এই ভেবে। তাই ঘরের কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও করছিলো মন দিয়ে। স্কুলও করছিলো নিয়মিত। কিন্তু হঠাৎ তার দিকে নজর পড়ে নাজমুল হোসেন নামের এক কিশোরের। বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার পথে একই গ্রামের আব্দুর রশীদের ছেলে নাজমুল রাস্তায় প্রায় প্রতিদিন প্রেমসহ কুপ্রস্তাব দেয়। এতে বিরক্ত হয়ে শামীমা বিষয়টি তার পরিবারকে জানায়।

এরপর শামীমার পরিবার নাজমুলের পরিবারকে জানালে কয়েকদিন নিরব থাকে। কিছুদিন পর আবারও শামীমাকে প্রেমসহ কু-প্রস্তাব দেয় নাজমুল। প্রস্তাবে রাজি না হলে তাকে জোড় করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয়ভীতি দেখায়। বাধ্য হয়ে শামীমার বাবা থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। থানায় বসে নাজমুল প্রতিশ্রুতি দেয় শামীমাকে আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। “প্রেম মজিলে মনে, কার বাঁধা কে শোনে।” এবার যেখানেই শামীমাকে দেখতে পায়, সেখানেই নাজমুল প্রেমের প্রস্তাব চালিয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন চার দেয়ালের মাঝে বিছানায় বন্দি শামীমা। তার স্বপ্ন যেন অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছে বালিশে।

পরে শামীমার চাচা সুমন হোসেন বাদী হয়ে বদলগাছী থানায় মামলা করেন। বর্তমানে স্কুল ছাত্রী শামীমা জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

মামলা সুত্রে জানা যায়, গত ২৭ আগষ্ট দুপুরের পর নাজমুল তার ভাতিজীকে বাড়িতে একা পেয়ে বিবস্ত্র ও শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। শামীমার চিৎকারে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর বিষয়টি তার পরিবারের লোকজনকে জানালে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওই দিন রাতেই শামীমার বাবাকে গালিগালাজ করতে থাকে। চাচা নিষেধ করলে তারা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে মারধর করে। এবং নাজমুলের পরিবারের নারী সদস্যরা শামীমার ঘরে ঢুকে তাকে শারিরীক নির্যাতন করে তার মুখে ঘাস মারা বিষ (আগাছা নাশক কীটনাশক) ঢেলে দেয়। পরে শামীমা এবং তার পরিবার বদলগাছী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়। শামীমার অবস্থা আশংকাজনক হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড করেন। প্রথমে নওগাঁ এবং পরে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া হয়। পরে শামীমার চাচা সুমন হোসেন বাদী হয়ে ঘটনার পরের দিন বদলগাছী থানায় অভিযোগ দিলে পরবর্তীতে ৯ সেপ্টেম্বর থানার অফিসার ইনচার্জ এজাহার হিসাবে গ্রহণ করে।

গত সোম ও মঙ্গলবার (২৮-২৯ অক্টোবর) সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় অনেকের সাথে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন বলেন, শামীমা আমার নাতনি হয়। এরকম ঘটনা আগে কখনো দেখিনি। এটা কেমন বর্বরতা। মেয়েটা যেকোন সময় মারা যেতে পারে। তার হাত, পায়ের চামড়া উঠে যাচ্ছে। সেই সাথে মাথার চুলও পড়ে গেছে। আমি এই ঘটনার কঠিন বিচার চাই। এছাড়া এতো তারাতাড়ি কিভাবে অন্য আসামিরা জামিন পায়, সেটা আমার বোধগম্য নয়।

স্থানীয় আলেয়া ও পরিমনি জানান, ঘটনা শুনেছি। এই ঘটনার বিচার হওয়া উচিত।

ভুক্তভোগী শামীমা বিছানায় শুয়ে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন, এমন ঘটনার বিচার চাই। ফিরতে চাই স্বাভাবিক জীবনে। নিরাপদে যেতে চাই প্রিয় বিদ্যালয়ে।

আর শামীমার বাবা শামীম হোসেন বলেন, আমার মেয়ে বর্তমানে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মেয়ে এবং পরিবারের নিরাপত্তা চাই। আসামিরা মামলায় জামিন হওয়ার পর নানাভাবে এখনও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মামলা তুলে নিতে আর আমরা যেন চুপ থাকি। আমি এক অসহায় দিনমজুর। আমরা সঠিক বিচার চাই। কঠিন এক পরিস্থিতি পার করছে আমার মেয়েটা। উত্যক্তের প্রতিবাদ করাই কাল হয়ে দাঁড়ালো।

ঘটনার দায়ভার অস্বীকার করে উল্টো নিজেদের পক্ষেই সাফাই করে অভিযুক্ত নাজমুলের বাবা আব্দুর রশীদ ও মামলার আসামি চাচাতো কিশোর ভাই জাহিদ হোসেন বলেন, ছেলে মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাদেরকে আমরা মারিনি। আর শামীমাকে আমরা বিষ খাওয়াইনি। তারাই হয়তো তাদের মেয়ের মুখে বিষ দিয়ে আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। কারণ জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। তবে কিছুটা হাতাহাতি হয়েছে।

বদলগাছী থানার অফিসার ইনচার্জ মো.শাহজাহান আলী বলেন, এঘটনায় প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছিল। বাকিরা জামিন নিয়েছে। আর বগুড়া (শজিমেক) শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমসির জন্য আবেদন করা হয়েছে। এমসি রিপোর্ট আসলেই চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে।

এদিকে একই এলাকার নাজমুলের একাধিক সহপাঠীরা জানান, তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। হয়তোবা মেয়ের পরিবার মেনে নেয়নি। তাই তাদের মধ্যে মারপিটের এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে তদন্ত করে সঠিক ঘটনা উদঘাটন করে জড়িত ব্যক্তিদের কঠিন বিচার দাবি করেন তারা।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print