ডিসেম্বর ৩, ২০২৩ ১১:৪৪ পিএম

বগুড়ায় রেশম উৎপাদন নেমেছে তলানীতে

বগুড়ায় দুই যুগের ব্যবধানে রেশম গুটি উৎপাদন ও বিতরণ কমেছে শতভাগ। সাম্প্রতিক সময়ে জেলা রেশম উন্নয়ন বোর্ডে (বীজাগার) বছরে উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ হাজার রেশম ডিম। ২৬ বছর আগে এই উৎপাদন ছিল প্রায় পাঁচ লাখ ডিম।

আড়াই দশক ধরে রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদন তলানীতে থাকলেও তা বাড়াতে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। তবে বগুড়া রেশম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি চাহিদা অনুযায়ী তারা রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদন করছেন।

উৎপাদন কমে যাওয়ার নেপথ্যে কারণ হিসেবে তারা দায়ী করছেন আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং বিদেশ থেকে রেশম সুতার বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক, রেয়ন আমদানিকে। সেই সাথে মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত তুঁত চাষী না থাকায় রেশম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হচ্ছে বলেও দাবি তাদের। উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় রেশম চাষে উৎসাহ হারিয়েছেন কৃষকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার লতিফপুর কলোনিতে একশ পাঁচ বিঘা জমিতে গড়ে ওঠা রেশম উন্নয়ন বোর্ডের তুঁত বাগানে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বছরে ৪-৫ লাখ রেশম ডিম উৎপাদন করা হয়েছে। সেখান থেকে পাঁচ হাজার রেশম ডিম বগুড়ায় রেশম চাষের কাজে ব্যবহার করা হত। বাকিগুলো পাঠানো হতো দেশের বিভিন্ন রেশম কারখানায়।

বগুড়ায় চাষ করা পাঁচ হাজার ডিম থেকে গড়ে এক হাজার থেকে এক হাজার পাঁচশ কেজি গুটি উৎপাদন করা হতো।

২৬ বছর আগে থেকে জেলায় কমতে শুরু করেছে ডিম ও গুটি উৎপাদন। বর্তমানে বছরে পাঁচ হাজার ডিম উৎপাদন করা হচ্ছে। এই পরিমাণ ডিম থেকে বগুড়ায় চারশ থেকে পাঁচশ ডিম চাষ করা হয়। বাকিগুলো দেশের বিভিন্ন কারখানায় পাঠানো হয়। জেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে দুইশত কেজি গুটি উৎপাদন করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রেশম ডিম বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত থাকলে বছরে ২৫ থেকে ৩০ কেজি গুটি উৎপাদন হয় বগুড়ায়।

বগুড়া রেশম উন্নয়ন বোর্ডে শ্রমিক হিসেবে ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন কিয়াস আলী। আর ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন ইব্রাহীম হোসেন।

তারা জানান, ২৬ বছর আগেও এখানে প্রচুর রেশম ডিম উৎপাদন করা হত। কিন্তু বর্তমানে তা একদমই কমে গেছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষক কমেছে।

কেন কমে গেল রেশমের কোকন উৎপাদন

তুঁত গাছ থেকে রেশম পোকার ডিম দিয়ে তৈরি হয় গুঁটি বা কোকন। সেই কোকন থেকে তৈরি হয় বাংলার ঐতিহ্যবাহী রেশম সুতা। আর এই সুতা দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে সিল্ক জাতীয় বস্ত্র। এক সময় এদেশে ব্যাপক চাহিদা ছিল রেশমের সিল্কের শাড়ি-কাপড়ের। বর্তমানে সিল্কের বস্ত্রের চাহিদা থাকলেও দেশীয় সিল্কের বাজার মন্দা।

বিদেশ থেকে রেশমের বিকল্প সুতা আমদানি

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রেশমের স্থান এখন অনেকটাই দখল করেছে বিদেশ থেকে আমদানি করা সিনথেটিক ও রেয়ন। দেশীয় রেশম সুতার দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় অধিক লাভের আশায় চীন ও ভিয়েতনাম থেকে সিনথেটিক ও রেয়ন সুতা আমদানি করছেন বস্ত্র ব্যবসায়ীরা।

আবহারওয়ার পরিবর্তন

অপরদিকে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে ডিম উৎপাদন কমেছে বগুড়ার সরকারি রেশম ফার্মে। বগুড়ার লতিফপুর কলোনির সরকারি তুঁত ফার্মে রেশম পোকা পালন এবং ডিম উৎপাদন করা হয়। বছরে চারবার এসব ডিম সংগ্রহ করে কৃষকরা।

রেশম ডিম উৎপাদনের জন্য ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পোকা পালন করতে হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রির ওপরে।

অপরদিকে ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় তীব্র শীত। তাপমাত্রা নেমে যায় ২৫ ডিগ্রির নিচে। তাই শীত শুরু হওয়ার আগের মাস অর্থাৎ অগ্রহায়ণ এবং শীত শেষ হওয়ার পরবর্তী মাস অর্থাৎ চৈত্র মাসে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা। বছরে মাত্র দুই মাস ডিম উৎপাদন করায় রেশম উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

তুঁত চাষে কৃষকের অনাগ্রহ

বর্তমানে বাজারে রেশমের চাহিদা কম থাকায় কৃষক তুঁত চাষে লাভবান হচ্ছেন না। কাঙ্ক্ষিত লাভ না হওয়ায় রেশম চাষে আয় কমে গেছে স্থানীয় কৃষকদের। ফলে তারা রেশম চাষে উৎসাহ হারিয়েছেন। কৃষকের অভাবে তুঁত চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেলার রেশম বোর্ডের কর্মকর্তাদের।

এছাড়া জোন পরিবর্তন হওয়ার দরুণও বগুড়ায় রেশমের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে গেছে বলে জানান বগুড়া রেশম উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপক মো: আহসানুল হক।

আহসানুক হক বলেন, পূর্বে বগুড়া জোনের মধ্যে নওগাঁ জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। নওগাঁর উৎপাদনকে বগুড়া বোর্ডের উৎপাদনের সাথে যোগ করা হত। বর্তমানে নওগাঁ রাজশাহী জোনে পড়েছে। ফলে ঐ জেলার উৎপাদনের অংশ বগুড়া বোর্ডের মোট হিসাব থেকে কমে গেছে।

রেশমের উৎপাদন কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আহসানুল হক বলেন, উৎপাদন কমে গেছে বিষয়টি এমন নয়। সরকারি চাহিদা এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাষ করা হচ্ছে। তবে বিদেশ থেকে রেশমের বিকল্প সুতা আমদানি হওয়ায় সারাদেশেই রেশমের চাহিদা কমেছে। এতে চাষ লাভজনক না হওয়ায় রেশম চাষে অমনোযোগী হয়েছেন কৃষকরা।

আবহাওয়ার পরিবর্তনকে রেশমের গুটি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।

বগুড়া রেশম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেশম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ বিঘা জমি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাষ হয়েছে রাস্তার পার্শ্ববর্তী ১৪ টি ব্লক এবং ১৩ বিঘা উঁচু জমিতে।

এর আগে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১৫ বিঘা জমিতে তুঁত চারা রোপন করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে আড়াই হাজার ডিম উৎপাদনের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০ বিঘা জমিতে তুঁত চারা রোপন করা হয়েছিল। উৎপাদন করা হয়েছে ২২০ কেজি রেশম গুটি বা কোকন।

এনসিএন/এসকে

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সম্পর্কিত