মে ২৩, ২০২৫ ৭:১৭ এএম

মতিউরের অলৌকিক বেঁচে ফেরা; চাইলেন বিচার

বাড়ির গেটে বাবার ছেড়া ও রক্ত মাখা প্যান্ট হাতে নিয়ে কাঁদছে মেয়ে মুনিকা খাতুন। আর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছে বাবা বেঁচে থাকার জন্য। এই প্রতিবেদককে প্যান্টটি দেখিয়ে দিয়ে বাবার বেঁচে ফেরার কাহিনি বলছিল সে। বলছিলাম নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় পারইল ইউনিয়নের পারইল গ্রামের হবিবর রহমানের ছেলে মতিউরের কথা। দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করা ট্রেনের নিচে পড়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে আছেন তিনি। কোউ বলছেন মতিউরের মায়ের দুধের জোরে বেঁচে আছেন, কেউবা বলছেন আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও একেকজনের একেক মন্তব্য শোনা যায় মতিউরের বাড়িতে গিয়ে।

মতিউর রহমান গত ৪০ দিন আগে বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার তালশন গ্রামের হেলাল প্রামাণিকের ছেলে সজীব প্রামাণিককে (৩২) একটা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। অভিযোগ তার চাকরি দেরিতে হওয়ায় তাদের আত্মীয় স্বজনরা চোরের অপবাদ দিয়ে মতিউরকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। এই জন্য সজিবের শ্যালক একই উপজেলার ডহরপুর এলাকার সিরাজুল ইসলামের ছেলে সুমনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৬-৭ জনকে আসামি করে সান্তাহার রেলওয়ে থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। আর সজিবের বাবার দাবি তাদের কেউ এই ঘটনার সাথে জড়িত না।

জানা যায়, বিদেশে লোক পাঠিয়ে বৈধ কাগজপত্র দিতে দেরি করায় মোবাইল চোর আখ্যা দিয়ে এক ব্যক্তিকে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে টে‌নে হিঁচড়ে ‌নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রোববার (১৮ মে) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার নশরৎপুর স্টেশনে বগুড়া থেকে সান্তাহার অভিমুখী একটি কমিউটার ট্রেনে এই ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনার ৩৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা এবং সমালোচনা।

ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে অনেকেই মতিউরকে চোর এবং ছিনতাইকারী বলে দাবি করছেন। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মতিউরের পরিবারের সদস্যরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার এক এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কাজ করছেন। সৌদি আরবে গিয়ে সজীবের বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় তার পরিবারের সদস্যরা ৭-৮ দিন আগে মতিউরের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চায়।

এ নিয়ে সেখানে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে বগুড়া থেকে ট্রেনে মতিউরকে একা পেয়ে সজীবের ছোট ভাই রাকিব এবং সজীবের শ্যালকরা মিলে মোবাইল চোর এবং ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তার কাছে থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন বলে অভিযোগ মতিউরের পরিবারের।

ভুক্তভোগী মতিউর রহমানের ছেলে আহসান হাবিব বলেন, আমার বাবার মুঠোফোন থেকে ফোন আসে। এরপর জানানো হয় আমার বাবার অবস্থা খুব খারাপ। সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনে গেলে একজন জানান আমার বাবা চোর। চুরি করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে এরকম অবস্থা হয়েছে। তারপর আমরা ঢাকার অফিসসহ বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে প্রমাণ দিলে তার একসময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। আমার বাবার সাথে যারা এরকম করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই। তবে আমার বাবা সত্য পথে থাকার জন্য আল্লাহ নিজ হাতে বেঁচে দিয়েছেন।

মতিউর রহমান বলেন, সৌদি আরবে ভালোভাবেই সজিবকে পাঠিয়েছি। কিন্তু সেখানে চাকরি না পাওয়ার কারণে তাদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে বগুড়া থেকে ট্রেনে বাড়িতে ফেরার পথে সজিবের শ্যালক সুমনসহ ৭-৮জন চোরের অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। মোবাইল চোর বলে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় খুব কষ্ট করে প্রায় ৪-৫ মিনিট ট্রেনের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম।

আমার কাছে ব্যবসায়িক কাজের ৫০ হাজার টাকা ছিল সেটিও তারা কেড়ে নেয়। আমি তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।

তিনি আরও বলেন, এক পর্যায়ে ট্রেনটি আদমদিঘী উপজেলার নশরৎপুর স্টেশনে এলে সেখানকার প্লাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে যায়। এরপর কি হয়ছিল আর বলতে পারবো না।

প্রতিবেশী নাজমা খাতুন ক্ষাোভ নিয়ে বলেন, তার বাবা ছিল একজন সুনাম ধন্য চেয়ারম্যান। মতিউর দাদন ব্যবসায়ী এটা ঠিক আছে। কিন্তু সে চোর বা ছিনতাইকারী ছিল এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।

মতিউরের বাবা হবিবর একসময় সুনামের সহিত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন জানিয়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মামুনুর রশীদ বলেন, মতিউর আদম ব্যবসার সাথে জড়িত। কিন্তু সে চোর বা ছিনতাইকারী না। আর সে যদি কোন অন্যায় করে থাকে তাহলে আইনের মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত। তাই এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের বিচার হওয়া উচিত।

মতিউরের মেয়ে মুনিকা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার বাবার সাথে যারা এরকম করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।

ছেলে আহসান হাবিব বলেন, আমার বাবা বেঁচে ছিল এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না। কারণ এই অবস্থায় থেকে বেঁচে ফেরার কথা না। বাবার নসিবে ছিল তাই এখনও বেঁচে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে।

বিদেশ যাওয়ার জন্য স্থানীয় একজন টাকা দিয়েছিলেন মতিউরকে। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় টাকা ফেরত চায় সেই যুবক।

৪০ হাজার টাকা দিতে তালবাহানা করলে স্থানীয় ইউনিয়ন  জামায়াতের অফিসে বিচার দেওয়ার পর ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় বাংলাদেশ জামায়াতের নের্তৃবৃন্দরা। আর এই দায়িত্ব পালন করেছেন পারইল ইউনিয়নের ৫ নং ওযার্ডের সাবেক আমির মো: সিরাজুল ইসলাম। তিনিও জানালেন, মতিউর চোর বা ছিনতাইকারী না। আর তার এই বেঁচে ফেরা অলৌকিক।

পারাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান মতিউরের আদম বয়বসার কথা স্বীকার করে বলেন, হয়তো সে দুই একজনকে বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হতে পারে। তবে সে চোর বা ছিনতাইকারী না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদেশরত সজিবের বাবা হেলাল প্রামাণিক মুঠোফোনে বলেন, আমার ছেলে প্রায় এক মাস ১০ দিন আগে কোম্পানির ভিসায় বিদেশ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে জানা যাচ্ছে সাপ্লাই ভিসায়। এখনও কোন কাজ দেয়নি আমার ছেলেকে। তাই মতিউরকে একদিন বাড়িতে ডেকে এনে প্রমাণ হিসেবে স্ট্যম্প করে নেওয়া হয়েছে। আর ট্রেনের ঘটনা কি সেটদ আমার জানা নেই। এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

সান্তাহার রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ হাবিবুর রহমান অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। এবং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে তাকে ধরার জন্য অভিযান শুরু করা হয়েছে। এছাড়া মূল ঘটনা উদঘাটনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print