ডিসেম্বর ১, ২০২৫ ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

যাত্রাশিল্পের গল্প নিয়ে ‘রূপশ্রী অপেরা’র মোড়ক উন্মোচন

একসময় যাত্রাপালা ছিলো গ্রাম বাংলার বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম। ৮০দশকের পর থেকে সুস্থ্য বিনোদনের এই ধারাটি হারিয়ে গেছে। তৎকালীন সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যাত্রাদল ছিল ‘রূপশ্রী অপেরা’। সেই সময় যাত্রাদল বলতেই মানুষ বুঝে নিতো নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার বিখ্যাত “রূপশ্রী অপেরা” এর কথা।

বর্তমানে বিভিন্ন কারণে দেশের এই ঐতিহ্য যাত্রাপালা হারিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত ছিলো তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। আর যারা বেঁচে আছেন তাদের সবাই কোন মতে টিকে আছেন। কিন্তু সেই সময় যারা “রূপশ্রী অপেরা” যাত্রাদলের পরিবেশিত যাত্রা দেখেছেন তাদের কর্ণ কুহুরে এখনোও যাত্রার অভিনয় শিল্পীদের ডায়ালগ বেজে ওঠে। চোখে ভেসে ওঠে অভিনয় শৈলী। শীতের রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে রাত জেগে গ্রামবাংলার মানুষ যাত্রা দেখায় মজে থাকত।

সেই ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা এর অভিনয়শিল্পী, ইতিহাস ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবদান নিয়ে ‘রূপশ্রী অপেরা’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। “রূপশ্রী অপেরা” বইটিতে স্থান পেয়েছে যাত্রার উঠে আসা এবং বিলিন হওয়ার গল্প। যাত্রাপালার সাথে যেসব শিল্পী জড়িত তাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে নওগাঁ শহরের প্যারীমোহন সাধারণ গ্রন্থাগার মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। ইতিহাস গবেষণাধর্মী ‘রূপশ্রী অপেরা’ বইটি লিখেছেন তরুণ গবেষক ও লেখক মোস্তফা আল মেহমুদ।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা ও প্রাবন্ধিক মামুন সিদ্দিকী।

স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সভাপতি ডিএম আব্দুল বারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল আলোচনক হিসেবে বক্তব্য রাখেন নওগাঁর বদলগাছী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক রবিউর রফিক। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, লেখক ও গবেষক আতাউল হক সিদ্দিকী, নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম খান, নওগাঁ জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এ এস এম রায়হান আলম, রূপশ্রী অপেরা যাত্রা দলের কর্ণধার খগেন্দ্র নারায়ন লস্করের ছোট ভাই সত্যন্দ্র নারায়ন লস্কর, যাত্রাশিল্পী সন্তোষ কুমার প্রমুখ। এসময় যাত্রাশিল্পের সাথে জড়িত পরিবারের সদস্য, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সুধিজনরাও উপস্থিত ছিলেন।

বইয়ের লেখক মোস্তফা আল মেহমুদ রাসেল বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল মাঠে যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়েছিল। স্কুলের আর্থিক সহযোগিতার জন্য ওই যাত্রাপালা আয়োজন করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। তখন যে দলটি যাত্রাপালা করেছিল তার নাম ছিল ‘রূপশ্রী অপেরা’। সেদিন রূপশ্রী অপেরা দলের পরিবেশিত ‘একটি পয়সা’ যাত্রাপালাটি দেখে শিশু মনে গভীর দাগ কেটে যায়। অনেক পরে জেনেছি সেই যাত্রা দলটির মূল কর্ণধার খগেন্দ্র নারায়ন লস্করের বাড়ি নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ভাটকৈ গ্রামে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল রূপশ্রী অপেরা নিয়ে একটা কাজ করব। এই বইটাতে রূপশ্রী অপেরা যাত্রা দলটির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তার কুশীলবদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি, বইটি সবাইকে আনন্দ দেবে এবং জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবে।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাবন্ধিক ও গবেষক মামুন সিদ্দিকী বলেন, গ্রামের যেসব সাধারণ মানুষ রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো বড় বড় লেখকদের লেখা পড়েনি তাঁরা মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রেরণা পেয়েছে যাত্রাপালার মতো লোকজ সংস্কৃতি থেকে। যাত্রা হলো বাঙালির অন্যতম সাংস্কৃতিক হাতিয়ার। ‘রূপশ্রী অপেরা’ সেই সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা। রূপশ্রী অপেরা দলটি যাত্রাপালা পরিবেশনের মাধ্যমে মনুষ্যতের সাধনা করে গেছেন। বইটিতে উঠে এসেছে এক সময় বরেন্দ্র অঞ্চলে তমুল জনপ্রিয় ছিল এই যাত্রা দলটি। নব্বইয়ের দশকে যাত্রাদলটি ভেঙে যাওয়ার পর দলটির কুশীলবরা কে কোথায় চলে গেছে, কিভাবে আছেন আমরা তার খোঁজ করিনি। কিন্তু বইয়ের লেখক মোস্তফা আল মেহমুদ বিবেকের তাড়না থেকে, আত্মপরিচয় খোঁজার তাড়না থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি যাত্রা দল রূপশ্রী অপেরার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে এনেছেন এই বইটির মাধ্যমে। একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চার একটি অমূল্য অংশ হয়ে থাকবে গ্রন্থটি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print