সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এক শিক্ষককে থানায় ডেকে নিয়ে এসে তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে ওসি নুরে আলম সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। লক্ষ্মী রাণী নামের এক মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে ওই শিক্ষককে নারী ও শিশু ডেস্কে সাড়ে তিন ঘন্টা তালাবদ্ধ করে রাখেন তিনি।
বিষয়টি জানাজানি হলে তড়িঘড়ি করে সেই শিক্ষককে ওসির রুমে নিয়ে এসে বসান। ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার বিকেলে নওগাঁ সদর মডেল থানায়।
ভূক্তভোগী শিক্ষকের নাম নগেন্দ্র নাথ দেবনাথ। তিনি শহরের চক প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সহকারী শিক্ষক এবং গণমাধ্যমকর্মী মিলন চন্দ্র দেবনাথের বড় ভাই। তার গ্রামের বাড়ি পার-বাঁকাপুর হলেও দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানেই থাকছেন।
আর শহরের হাট-নওগাঁ এলাকার অভিযোগকারী লক্ষ্মী রাণী সুদের ব্যবসা করেন বলে অভিযোগ করেন ভূক্তভোগীরা। যদিও সুদের বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ থানার ওসি ও লক্ষ্মী রাণীর পক্ষে আসা প্রভাবশালীরা।
তাই প্রভাবশালীর একজন হুমকি স্বরুপ নগেন্দ্র’র কাছে জানতে চান তিনি টাকা দিবেন কিনা।
অপরদিকে তার পক্ষে সাফাই গেয়ে ওসি দাদন ব্যবসায়ীর বর্ণনা শোনালেন। দাদন ব্যবসায়ী তারাই হয়, যাদের পেশি শক্তি থাকে এই বলে। তবে একসময় অভিযোগকারী নিজেই সুদের বিষয়টি স্বীকার করেন।
জানা যায়, ব্যবসার কাজে ২০১৬ সালের দিকে লক্ষ্মী রাণীর কাছ থেকে চড়া সুদে তিন দফায় মোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়েছিল শিক্ষক নগেন্দ্র নাথ। সেই টাকার বিপরীতে লক্ষী রাণীকে মাসিক মুনাফা হিসাবে ২২ হাজার টাকা দিতে হতো। একদিকে ব্যবসায় লোকসান, অন্যদিকে একের পর এক ঋণের বোঝা মাথায় চেপে বসে নগেন্দ্র নাথের ওপর। তাই একসময় পালিয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। এমনকি তার এলাকার বিভিন্ন পাওনাদারদের কারণেও হয়েছিলেন এলাকা ছাড়া। এখনও যেতে পারেন না এলাকায়।
এদিকে মুনাফা দেওয়া বন্ধ হওয়ায় ততকালীন এক এমপির সুপারিশে লক্ষ্মী রাণীর শ্বশুরাড়ি জেলার মহাদেবপুর উপজেলার এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মাধ্যমে গত ২-৩ বছর আগে কয়েকটি ফাঁকা চেক ও স্টাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয় শিক্ষক নগেন্দ্র’র কাছ থেকে।
ভূক্তভোগী শিক্ষক নগেন্দ্র নাথ দেবনাথ বলেন, বুধবার হঠাৎ সাড়ে ১২টার সময় নওগাঁ সদর মডেল থানার ওসি স্যারের কল পেয়ে থানায় আসি। থানায় এসে জানতে পারি লক্ষ্মী রাণী নামের একজন আমার নামে অভিযোগ করেছে।
নগেন্দ্র নাথ বলেন, লক্ষ্মী রাণীর কাছে থেকে সুদের উপর টাকা নিয়েছিলাম। বিভিন্ন সময় সুদের টাকা দিয়েছি। একসময় টাকা দিতে অপরাগত প্রকাশ করায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ওসি স্যার আমাকে এখনই টাকা দিতে বলেন। যদি না দিতে পারি, তাহলে অভিযোগের ভিত্তিতে কোর্টে চালান করে দিবে।
তিনি আরও বলেন, এক পর্যায়ে আমাকে সোয়া একটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত থানাতে আটকে রাখে। পরে আমার প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং কালিতলার মিঠু নামের এক ভাইয়ের সহযোগীতায় এবং ওসি স্যারের হস্তক্ষেপে আগামী রবিবার এই বিষয়ে একটি মিটিং হবে। সেখানে অল্প করে ২-৪হাজার টাকা লক্ষ্মী রাণীকে দেওয়ার শর্তে আমাকে থানা থেকে ছেড়ে দেন ওসি স্যার।
ইতিমধ্যে আমি তাকে সুদ বাবদ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা শোধ করেছি। এবং তার ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে ৭০হাজার টাকা শোধ করেছি। অথচ এই লক্ষ্মী রাণী পুরোপুরি অস্বীকার করেন। এখন আমার একটাই চাওয়া আমি যেন একটা সুষ্ঠ পরিবেশে চাকরি করতে পারি। এবং সঠিক সমাধান হয়।
একইভাবে সঠিক সমাধান চেয়ে তার ছোট ভাই মিলন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আমার দাদাকে ওসি ডেকে নিয়ে এসে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। টাকাগুলো ফেরত দিলে মামলা দিবেনা, অন্যথায় মামলা দিবে বলে একপ্রকার হুমকি দেয়। সুদের পাওনা টাকার জন্য তিনি আমার দাদার সাথে এমনটি করলেন। যা মোটেও কাম্য নয়। আর ওই মহিলা কি অভিযোগ দিয়েছিলেন সেটা ওসি ব্যাখ্যা দিবেন। লক্ষ্মী রাণী আমার দাদার কাছ থেকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নিয়েছে।
এদিকে ওসির সামনে আরও দুই একজনকে টাকা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন লক্ষ্মী রাণী। এবং নগেন্দ্র নাথ লাখে দুই হাজার টাকা লাভ দিতে চেয়েছে বলে জানান তিনি। এমনকি মাঝে মাঝে লাভের টাকা দিতে চেয়েও দেননি বলে মৃদস্বরে অভিযোগ করেন। এরপর বাহিরে এসে পুরোপুরি উল্টো সুর তার।
জানতে চাইলে, শোনেন ভাই আমি একটা গরীব মানুষ। ওই চ্যাংরা (শিক্ষক নগেন্দ্র) আমার বাসায় পড়াতো। আমি ওকে টাকাটা ধার দিছি। ওই টাকাটা নিব, এই জন্য আমি এসেছি এভাবেই বলেন লক্ষ্মী রাণী। সর্বশেষ টাকা দিতে রাজি হয়েছে। তাই মামলা করবো না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তারা সবাই বসে মিউচাল করে দিবে। আর এক টাকাও মুনাফা দেয়নি সে। আমি এমনিই তাকে ধার দিয়েছি। সুদের ব্যবসা করিনা।
এ বিষয়ে নওগাঁ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূরে আলম সিদ্দিকী জানান, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই টাকা পাবে তার কাছে থেকে। তাই জিজ্ঞাবাদের জন্য তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
বিকেল চার টার দিকে জানতে চাইলে নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) গাজিউর রহমান ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে জানান, নগেন্দ্র নামের ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে চেক ডিজ অনারের ৩টি মামলা রয়েছে। তার নিকট থেকে আরো অনেক ব্যক্তি টাকা পাবেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি একজন মহিলার নিকট থেকে সে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আর ফেরৎ দেয় নি। টাকা ফেরৎ চাইলে বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করে এবং বিভিন্ন প্রকার হুমকি প্রদান করে মর্মে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট ওই মহিলা লিখিত অভিযোগ করেন। উক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে থানায় ডাকা হয়। পরবর্তীতে সে তার বক্তব্য প্রদান করে চলে যায়। তাকে আটকে রাখার বিষয়টি সঠিক নয়। এরপরেও যদি ওসির বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ থাকে তাহলে পুলিশ সুপারকে লিখিত ভাবে জানালে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
