অক্টোবর ১৫, ২০২৫ ৯:২৬ পিএম

আলু চক্রে লোকসান গুনছেন কৃষকেরা

জমি থেকে আলু সংগ্রহ করছেন কৃষক মোফাজ্জল। ছবিটি মঙ্গলবার বগুড়া সদরের পল্লীমঙ্গল থেকে তোলা। ছবি: এনসিএন
জমি থেকে আলু সংগ্রহ করছেন কৃষক মোফাজ্জল। ছবিটি মঙ্গলবার বগুড়া সদরের পল্লীমঙ্গল থেকে তোলা। ছবি: এনসিএন

আলু চক্রে লোকসান গুনছেন কৃষকেরা। কথাটি পড়ে অদ্ভুদ মনে হলেও এটাই বাস্তবতা। আলু চাষে বেশ এগিয়ে বগুড়ার কৃষকেরা। তবে ‘আলু চক্রে’ চলতি মৌসুমে এই পণ্য চাষ করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তারা।

কৃষকের আলু কয়েক হাত বদল হয়ে পৌঁছায় ক্রেতাদের কাছে। এর মধ্যে কয়েকটি চক্রের গন্ডি পেরিয়ে যেতেই আলুর প্রকৃত দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মাঠের কৃষকেরা।

চলতি মৌসূমে বাড়তি দামের আশায় আগাম জাতের আলু চাষ করেন বগুড়া সদরের পল্লীমঙ্গল এলাকার কৃষক মোফাজ্জল (৩০)। তিনি চার বিঘা জমিতে বাড়ি-৭৭ জাতের আলু চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে ১ বিঘা জমির আলু বাজারজাতকরণ করেছেন তিনি। কিন্তু এখন নতুন করে আলু তুলবেন না এই কৃষক।

মোফাজ্জল জানালেন, ‘কিছুটা বাড়তি মুনাফার জন্য আগাম জাতের আলু চাষ করেছিলাম। কিন্তু বাজারে মাত্র ১০ টাকা কেজিতে এই আলু বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে যদি সব আলু বিক্রি করি তাহলে প্রচুর লোকসান হয়ে যাবে। তাই আর নতুন করে আর কোনো আলু তোলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি।’

শুধু মোফাজ্জলই নয়, তার মতো শতশত কৃষকই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাদের?

পুরোনো আলুর ২০ শতাংশ কোল্ডস্টোরে

বগুড়া জেলার বিভিন্ন কোল্ডস্টোরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরোনো আলুর প্রায় ২০ শতাংশ এখনো কোল্ডস্টোরে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব আলু ধীরে ধীরে বাজারজাত করা হচ্ছে। এতে নতুন আলুর সঙ্গে পুরোনো আলুর দামে বিশাল তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে। পুরোনো পাকড়ি আলু মানভেদে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন আলু ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় পুরোনো আলুই বেশি কিনছেন ক্রেতারা।

আড়তদার সিন্ডিকেট

বগুড়ার পল্লীমঙ্গলে ট্রাকে বোঝাই করে বাড়ি-৭৭ জাতের আলু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠাচ্ছেন আড়তদার শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কৃষকদের আলু ঘর থেকে আমরাই সংগ্রহ করি। এরপর সেগুলো বস্তাবন্দি করে দেশের বড় মোকামগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এতে কৃষকের বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না।’

কৃষকদের কাছ থেকে মানভেদে ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে আলু সংগ্রহ করছেন তিনি। এরপর সেগুলো মোকামে পৌঁছে গেলেই যাবতীয় খরচ বাবদ ১২ টাকা কেজিতে বিক্রি করে দিবেন।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের আলুর বাজার

উত্তরবঙ্গের বৃহৎ মোকাম বগুড়া মহাস্থান হাট। এই হাটে পল্লীমঙ্গল, রাজাপুর, মানিকচক, গাবতলী ও পীরগাছাসহ বিভিন্ন এলাকার আলু আসে। সেসব আলু পাইকারি দরে নিয়ে আসেন বগুড়ার রাজাবাজারের পাইকাররা।

রাজাবাজারের আলুর পাইকার সারোয়ার হোসেন বলেন, আমরা প্রতিদিন সকালে মহাস্থান হাট থেকে আলু সংগ্রহ করি। সেগুলো আবার এখানে খুচরা বিক্রেতা ও সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। তবে আবহাওয়ার কারণে নতুন আলু তোলা না হলে দাম উঠা-নামা করে বলেও জানান তিনি।

মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজাবাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারিতে বাড়ি-৭৭ (সেভেন) ১৬-১৭ টাকায়, ক্যারেজ ২৪ টাকায়, কাটিলাল ২৬ টাকায়, ফাটা পাকড়ি ৩৪ টাকায় এবং আঠা (হাগরাই) আলু ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খুচরা ব্যবসায়ী থেকে ক্রেতাদের হাতে

বগুড়ার শহরের রাজাবাজার ও ফতেহ আলী বাজারে নতুন জাতের আলুতে সয়লাব। চলতি মৌসূমে এই পণ্যের উৎপাদন ভালো হওয়ায় দামে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন ক্রেতারা।

ফতেহ আলী বাজারের খুচরা বিক্রেতা খোকন সরদার জানান, গতকাল রাতের বৃষ্টিতে নতুন করে আলু বাজারে প্রবেশ করেনি। এইজন্য আলুর দাম আজ কিছুটা বেড়েছে। বাজারে পুরাতন আলু ও নতুন আলুর মিশ্রণে ক্রেতারা সাধ্যমত এই পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন।

এই বাজারে আলুর দাম কৃষকের আলুর কয়েকগুন। বিভিন্ন জাতের আলু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে লাভজনক দামে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাড়ি-৭৭ (সেভেন) বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকাতে, ক্যারেজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়, কাটিলাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়, ফাটা পাকড়ি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায় এবং আঠা (হাগরাই) আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকাতে।

আলু চক্রে কৃষক ব্যতীত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সবাই লাভের অংশীদার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষক পর্যায়ে আলু সংগ্রহ করে বাজারজাতকরণে নানা জটিলতা অতিক্রম করতে হয়। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই এই পণ্যের দাম কয়েকগুন বেড়ে যায়। তবে কৃষকেরা এতে সেভাবে লাভবান হন না।

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে জেলায় ৫৫ হাজার ৬৯০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ২৫ হাজার ১৮০ মেট্রিক টন। ইতোমধ্যে ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর জমির আলু লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। এতে ১২ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের আশা করছেন তারা।

আলুর জাতের মধ্যে রয়েছে কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, সানশাইন, সুপার শাইন পাকড়ি, লাল পাকড়ি, ফাটা পাকড়ি, গ্রানোলাসহ ২০ থেকে ৩০টি জাতের আলু উৎপাদন হচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক এনামুল হক জানান, ‘বর্তমানে যে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে তাতে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এমনটা হলে আগামীতে আগাম জাতের আলু চাষে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে।’

এনসিএন/এআইএ

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print