আগস্ট ৬, ২০২৫ ৯:০২ পিএম

কাকার কাঁধে ভর করে পড়াশোনার স্বপ্নে ভাই-বোন; নেই ওষুধ কেনার টাকা 

একদিকে সিঙাড়া নিয়ে গ্রামের যাওয়ার প্রস্তুতি, অন্যদিকে ছোট্ট দুই শিশুকে স্কুলে পাঠানোর চিন্তা। আবার ছোট বোনের কিনতে হবে ওষুধ। হাতে নিয়ে ঘুরছে ভাতিজার প্রেসক্রিপশন। টাকা না থাকায় কিনতে পারেনি ওষুধ। সব দায়িত্ব যেন তার কাঁধে। জীবনের ভারের চেয়ে দায়িত্বের ভারই এখন তার বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অসহায়ের এই এই করুন গল্পটা নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার কুজাইল হিন্দু পাড়া গ্রামের পলাশ চন্দ্র প্রামানিক ও দুই ছোট্ট শিশু ১১ বছরের প্রীতম এবং ৭ বছরের প্রিয়সী’র।

জন্মের পর থেকেই তাদের জীবনের পথে শুধু হারের গল্প। ছোট্ট দুই শিশুর মা পূর্ণিমা চিকিৎসার অভাবে গত ১১ এপ্রিল নিজ বাড়িতে মারা গেছে। বাবা থেকেও নেই। মাকে হারিয়ে পৃথিবীটা যেন একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে তাদের জন্য।

অপরদিকে পলাশের জীবনের গল্প আরও করুন। তার ভাগ্যেও কখনও জোটেনি ভালো কিছু খাবার, হয়নি সামর্থ্য নতুন পোশাক কেনার। পলাশের যে ঘরে রাত কাটে হয়তো সেই ঘর থেকে কারো কারো গবাদি পশুর থাকার ঘরও এর চেয়ে ভালো হয়ে থাকে। তবুও রাত কাটছে তার। একই ঘরের মধ্যে খাওয়া, আছে জঙ্গল।

প্রীতম ও প্রিয়সী কম বুদ্ধিসম্পন্ন ডাবলু প্রামাণিকের সন্তান। আর পলাশ প্রামাণিক শিশু দুটির কাকা (চাচা)।

এদিকে প্রীতম গত দুই দিন থেকে জ্বরে ভুগছে। আধা পাগল বাবা ছেলের চিকিৎসার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে করে নিয়েছে প্রেসক্রিপশন। কিন্তু ওষুধ কিনতে না পেরে প্রেসক্রিপশন ধরে দিয়েছে ছোট ভাই পলাশের হাতে। পলাশ হয়তো আজ কিনবে ভাতিজার ওষুধ। মৃত্যুর একদিন আগেও প্রীতম ও প্রিয়সীর মা’র ইচ্ছে ছিল তার দুই সন্তানকে পড়াশোনা করানোর, তার স্বপ্ন যেন থমকে যেতে বসেছে। এখনই হাত পেতে কিনতে হচ্ছে ছেলের ৭ম শ্রেণির গাইড বই। তবে মৃত বৌদির (ভাবির) স্বপ্ন পূরণের আশায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেবর পলাশ চন্দ্র প্রামাণিক।

তাইতো সংসারের চিন্তায় কাকা পলাশ সাইকেলে ছুটলেন সিঙাড়া নিয়ে। তা বিক্রি করে যা আয় হবে সেটা দিয়েই চলবে সংসারের খরচ।

বুদ্ধির পর থেকেই সুখ নামক শব্দটি তার কপালে জোটেনি। পড়াশোনার পাশাপাশিই কাঁধ তুলে নিতে হয়েছে ব্যবসার ভাড়।

এদিকে মা হারা হয়েও থামেনি ছোট্ট দুই শিশুর স্বপ্ন। সকালে পুরোনো ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে তারা স্কুলে যায়। অন্যদের মতো নতুন পোশাক, দামি খাতা কলম নেই। অনেক সময় না খেয়েই ক্লাস করতে হয়। তবুও স্কুলে গিয়ে পড়তে চায়, বন্ধুদের মতো স্বপ্ন দেখতে চায় প্রিতম-প্রেয়সী। তাদের একমাত্র ভরসা কাকা পলাশ, যিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেও চাকরির পিছনে না ছুটে গ্রামে গ্রামে সিঙ্গাড়া বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালান। নিজের সংসারে চাল-চুল না থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট দু’ভাই বোনকে আগলে রেখেছেন মায়ের মতো করে। তাই তাদের চোখে আশা—একদিন মানুষ হবো, পরিবার আর সমাজের মুখ উজ্জ্বল করবো।

কিন্তু এই লড়াইয়ে কাকা পলাশ একা। অভাবের ঘূর্ণিপাকে হয়তো যেকোনো সময় থেমে যেতে পারে প্রীতম আর প্রিয়সীর স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন। সমাজের এগিয়ে আসা ছাড়া হয়তো স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যাবে, ঝরে যাবে নিমিষেই।

হতাশা নিয়ে কাকা পলাশ কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলেন, “নিজের সংসারও চলে না ঠিকমতো। তবু ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, স্কুলে যেও, মানুষ হইও। ওদের পড়াশোনা থেমে গেলে আমার মন ভেঙে যাবে। কষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত ওদের পাশে থাকবো।” আজ দুই দিন থেকে ভাতিজা জ্বরে ভুগছে, বোনও দুই মাস থেকে অসুস্থ। তাই মনটা খারাপ।  তিনি আরও বলেন, এলাকায় যেকোনো একটা চাকরির সুযোগ পেলে আমার জন্য খুব ভালো হতো। জীবনে নিজের জন্য কখনও পোশাক কিনতে পারিনি। দাদার মাধ্যমে একবার দুই বান্ডিল দিন ও কিছু টাকা পেয়ছিলাম, সেই টিন দিয়ে ঘর ঠিক করেছি। তারপরও স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা, বেঁচে আছি।

ডাবলু প্রামাণিক বলেন, আমি তেমন কাজ কাম করতে পারিনা। একসময় পেডেল আলা ভ্যান চালাতাম, খুব কষ্ট হতো। এখন মাঝে মাঝে গুড় ও মুড়ি নিয়ে গ্রামে গ্রামে যাই।

ব্যাট্যা আমার জ্বরে পড়ে আছে। খুব খারাপ লাগছে। ওষুধই কিনতে পারছি না। পড়াশোনা করামু কেমন করে?

ভাই-বোন প্রীতম ও প্রিয়সীর আজ একটাই আকুতি—”আমরা পড়তে চাই… মানুষ হতে চাই। আমাদের স্বপ্ন যেন না মরে যায়।”

প্রীতম প্রামাণিক বলেন, আমরা দুই ভাই বোন পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু কিভাবে করব জানিনা, আমার একটা গাইড কিনতে হয়েছে সাহায্য নিয়ে। আমার মা বেঁচে থাকলে তেমন চিন্তা হতো না।

একই ওয়ার্ডের মেম্বার হাফিজুর রহমান বলেন, ডাবলু প্রামাণিকের স্ত্রী মারা যাওয়ায় তার দুটো সন্তান অসহায় হয়ে পড়েছে। তার স্ত্রী মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতো। আমার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের একটা লাট্রিন (পায়খানা) দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। আর তার দুই ছোট্ট সন্তানের জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিৎ। পাশাপাশি পলাশ খুব ভালো ছেলে। সে পড়াশোনা অবস্থায় একসময় গ্রামে গ্রামে পায়ে হেঁটে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতো। এখনও কষ্ট করছে।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাকিবুল হাসান বলেন, আমি তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিবো। এরপর তাদের জন্য যেভাবে যতটুকু সহযোগিতা করা যায় আমি চেষ্টা করবো।

পূর্ণিমার মৃত্যুতে পার্শ্ববর্তীদের হৃদয় কেড়েছে ছোট্ট এই দুই ভাই-বোন। প্রতিবেশীরা জানান, এখন ছোট্ট দুই শিশুর কি হবে? কেমনে চলবে তাদের পড়াশোনা। পূর্ণিমা অন্যের বাড়িতে কাজ করেই সংসার ও দুই সন্তানের পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন।

তাদের এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় বটবৃক্ষ নামক বাবা-মা কাউকে যেন অল্প বয়সে হারাতে না হয়। তাহলে এরকম হাজার হাজার প্রীতম-প্রিয়সীর জীবন অকালে ঝরে যাবে, থেমে যাবে স্বপ্ন। তারপরও তাদের জীবন সুন্দর হোক এই প্রত্যাশা প্রতিবেশীদের।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print