আগস্ট ১০, ২০২৫ ৩:৪২ পিএম

ঘুষ ছাড়া কিছু বোঝেন না তারা; কাজ করেন মিলেমিশে

নওগাঁর রাণীনগরে হয়রানিসহ ঘুষের বিনিময়ে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে এক ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কর্মরতদের বিরুদ্ধে। ঘুষ ছাড়া কিছু বোঝেন না উপজেলার মিরাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পিওন সোহাগ ও প্রসেস সার্ভেয়ার আব্দুল কুদ্দুস। ঘুষের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই উপ-সহকারী কর্মকর্তা দুরুল হুদাও। 

হোল্ডিং করার অনুমতি নিতে হলে দিতে হবে দুই হাজার টাকা ঘুষ। চাহিদা মতো ঘুষ না দিলে জুটবেনা হোল্ডিং এন্ট্রির অনুমোদন। খারিজের জন্য কেউ ঘুষ দিয়েও ঘুরছে দিনের পর দিন। আবার নিয়ম না থাকলেও টাকার বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে প্রস্তাবিত খতিয়ান।

তবে পিওন সোহাগের দাবি তারা তিন জন মিলেমিশে প্রস্তাবিত খতিয়ান দেওয়ার কাজটি করেন। আর প্রসেস সার্ভেয়ার কুদ্দুসের দাবি দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও এই কাজটি গোপনে করতে হয়। অপরদিকে কর্মকর্তা দুরুল হুদার দাবি মিলেমিশে কাজ করলেও তিনি ঘুষের ভাগ নেন না।

কয়েকদিন সরেজমিনে গিয়ে এমনই তথ্য জান যায় মফস্বল এলাকার এই ভূমি অফিসে কর্মরতদের বিরুদ্ধে।

বুধবার ৬ আগষ্ট আজিজুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি গিয়েছিলেন দুই খতিয়ানের জমির খাজনা দিতে। অনলাইনে আবেদন করে গিয়েছিলেন উপ-সহকারী কর্মকর্তা দুরুল হুদার কাছে। অনেকক্ষণ বসে রেখে হোল্ডিং এর এন্ট্রি দিয়ে অনুমোদনের জন্য চেয়ে বসলেন দুই হাজার টাকা। ঘুষ দিতে না চাইলে অনুমোদন দেওয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন দুরূল হুদা। বাধ্য হয়ে তর্ক করে চলে যান। এভাবেই ক্ষোভ নিয়ে জানালেন ভুক্তভোগী আজিজুল।

একইভাবে ক্ষোভ নিয়ে হয়রানির কথা জানালেন ফজলু সরদার ও মজনু সরদার দুই ভাই। তারা এক বছর আগে পৃথক দলিলে ৬ শতক জমির খারিজের জন্য সোহাগের হাতে ঘুষ দিয়েছিলেন ৫ হাজার টাকা। কাজ হওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী আরও ৭ হাজার টাকা দেওয়ার কথা আছে। কিন্তু একবছর থেকে ঘুরেও কোন সমাধান পাচ্ছে না অসহায় ওই দুটি ভাই। তারা জানালেন, আমরা গরীব মানুষ। ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়ে গেছি। সোহাগ আমাদের শুধু দিন দিয়ে ঘুরাচ্ছে। কখনও বলে কাজ হয়ে গেছে। আবার ফোন দিলে ধরে না। টাকা ও কাগজ ফেরত চাইলেও দেয়না। ভাই একটা কিছু করেন। খুব উপকার হবে।

খতিয়ানের ১০ পিস ফটোকপি নিতে গিয়েছিলেন এক ব্যাক্তি। তার কাছে প্রতি পিস ২০০ টাকা করে ২ হাজার টাকা চেয়েছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। কিন্তু প্রতি পিস ১৫০ টাকা করে মোট দেড় হাজার টাকা দিতে চেয়েও ফটোকপি পাননি ওই ব্যক্তি। পরে অবশ্য ৫০০ টাকার বিনিময়ে অন্য একজন দিয়েছে।

এর আগে স্থানীয় ইয়াকুব নামের এক লোকের কাছে প্রস্তাবিত খতিয়ান দিয়ে দুই হাজার দুই শত টাকা ঘুষ নিয়েছে আব্দুল কুদ্দুস ও সোহাগ।

ইয়াকুব এই প্রতিবেদককে জানালেন, কুদ্দুস ও সোহাগ দুজনেই খুব খাইখোর। তারা ঘুষ ছাড়া কিছু বোঝে না। তুমি নিতে গেলে তোমার কাছ থেকে ৫-৭ হাজার টাকা নিবে।

অবশ্য পরিচয় গোপন রেখে প্রস্তাবিত খতিয়ান নিতে চাইলে সোহাগের সোজাসাপটা জবাব, এটা একটু কঠিন কাজ। তিন জন মিলে করতে হবে। তাই ৭ হাজার টাকা লাগবে। দর কষাকষি করে ৫ হাজার টাকায় রাজি হলেন। খতিয়ান নং চেয়ে তারা জানালেন এসব জিনিস কাউকে বলতে হয়না, গোপনে করতে হয়। নিয়ম ও বিধান নেই। আমাদেরকে দিবেন, নিয়ে এসে দিব। সব স্বাক্ষরসহ একদম অবিকল কপি পাবেন।

পিওন সোহাগ হঠাৎ একটি প্রস্তাবিত খতিয়ান বের করে গর্বের সহিত জানালেন, এইরকম হয়। ইয়াকুব ভাই কিছুক্ষণের মধ্যে নিতে আসবে, তার কাছে আরও (ম্যালা) বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে তাদের মিলেমিশে কাজ করার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া। প্রায় বিভিন্ন রকমের ১২ কেজি মাছ তাদের অফিসে সমান তিনটি ভাগে ভাগ করা হচ্ছিল।

আর মাছগুলো দেখে স্থানীয় নারী পুরুষ কৌতুহল বশত পিওন সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বললেন এইগুলো ঘুষ কে দিল? এখন এতো টাকা ঘুষ খেলে পরের জনমে সাথে যাবে কে?

জানতে চাইলে দুই হাজার টাকা চাওয়ার কথা অনায়াসে স্বীকার করলেন আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, এই অফিসে চাকরির ৮ মাসে ৮ টি খতিয়ানও বিক্রি করতে পারিনি। আর জাবেদার জন্য ২০০ করে চেয়েছিলাম। ঘুষ ছাড়া কিছু বোঝেন না এমন প্রশ্নে তিনি হেসে উড়ে দিলেন।

তিনি আরও বলেন, আমি কোন প্রস্তাবিত খতিয়ান দিইনি। সোহাগ দিয়েছে কিনা সে ভালো বলতে পারবে।

রোববার ১০ আগষ্ট সকালে জানতে চাইলে পিওন সোহাগ মুঠোফোনে বলেন, শুধুমাত্র অনলাইন খরচ নিয়েছি। আর তাদের কাগজ ঠিক ছিলনা। কাগজ দিয়ে গেছে। এখন পাশের অপেক্ষায় আছে। আর প্রস্তাবিত খতিয়ান দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। টাকার নিয়ে দিয়েছেন সেটার রেকর্ড আছেন এমন প্রশ্নে তিনি সদুত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান এবং রেকর্ড করা লাগলে আরও করে নিয়ে যান কোন সমস্যা নেই আমার ক্ষমতার সুরে বলেন এই পিওন সোহাগ।

জানতে চাইলে ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা দুরুল হুদা বলেন, অফিসে কাজ আমরা মিলেমিশে করি এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাদের ঘুষের কোন টাকা আমি নিইনা। আর টাকা নিয়ে কাজ না করা বা ঘুরানো এটা আমি মেনে নিব না। আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত খতিয়ান এই অফিসে নেই। এখান থেকে দেওয়া হবে না। এটা এসিল্যান্ড অফিস থেকে নিতে হবে। আর টাকা নিয়ে খতিয়ান দিয়ে থাকলে আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবো।

ঘুষ ছাড়া হোল্ডিং এন্ট্রির অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

তবে তিনি বারবার এই প্রতিবেদককে নিউজ করতে নিষেধ করেন। অনেক অনুরোধ করেন।

জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নওশাদ হাসান বলেন, ঘুষ নেওয়া তো দুরের কথা। ঘুষ চাইতেও পারবেনা। অভিযোগের সকল বিষয়ে তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ, মিরাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসটি উপজেলার শেষ সীমানায় মফস্বল এলাকায় হওয়ায় এই অফিসটা যেন ঘুষের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নজর না দেওয়ার কারণে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অতিষ্ঠ হচ্ছে স্থানীয়রা।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print