সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫ ৯:৪৮ পিএম

পদত্যাগের দাবিতে ফুঁসছে শিক্ষার্থীরা

ছাত্রীকে ওড়না ছাড়া দেখার ইচ্ছে পোষণ করা অধ্যক্ষের স্কিনশট এখন ভাইরাল

কলেজে ঢুকতেই একদিকে চোখে পড়বে উৎসুক শিক্ষার্থীদের ভীড়। সেখানে টানানো আছে একাধিক ব্যানার। তাতে দেওয়া আছে একটা ছবি ও কিছু বাক্য। কেউ মোবাইলে ছবি তুলছে, কেউ পড়ছে, আবার একে অপরকে দেখিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। 

অপরদিকে অপরপাশে চলছে মানববন্ধন। সেখানে বক্তব্য রাখছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। শ্লোগান দিচ্ছে এ্যাকশন এ্যাকশন, ডাইরেক্ট এ্যাকশন, প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট এ্যাকশন। পদত্যাগ করতে হবে।

ছাত্রীকে ওড়না ছাড়া দেখতে চাওয়ার স্কিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে পড়লে রোববার ১৪ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে গিয়ে এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে নওগাঁ সরকারি কলেজে।

কলেজে টানানো ব্যানারে দেখা যায় ওই কলেজের অধ্যক্ষে মো: সামসুল হকের ছবি দিয়ে কিছু বাজে বাক্য লেখা আছে।

সম্প্রতি অধ্যক্ষ-ছাত্রীর এমনই কিছু বাক্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অভিযোগ ওই কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: সামসুল হল একই কলেজের এক শিক্ষার্থীকে ওড়না ছাড়া দেখতে চেয়ে এসএমএস পাঠায়। এরপর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে টক অব দি শহরে পরিণত হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

অধ্যক্ষ সামসুল হকের পদত্যাগ চেয়ে শুরু করেন মানববন্ধন। এদিন সকালে কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মিলে এই মানববন্ধন করে। পড়ে কলেজ প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসা হয় সমাধানে।

এর আগে Shamsuddin Ahmed নামের এক ফ আইডি থেকে অধ্যক্ষের পাঠানো আপত্তিকর মন্তব্যের স্কিনশট ফেসবুকে শেয়ার করা হয়।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া স্ক্রিনশটগুলোর পাঠানো বাক্যগুলো দেখা যায়, অধ্যক্ষ সামসুল হক ছাত্রীর সুন্দরের প্রশংসা করে আরও সুন্দরী ছবি আছে তোমার’। ওই শিক্ষার্থী লেখেন, ‘আর নেই স্যার। আমি সুন্দর না। আমার যা মনে হয়’। তখন সামসুল হক লেখেন, ‘আছে আছে, ওড়না ছাড়া’। উত্তরে শিক্ষার্থী লেখেন, ‘নেই স্যার, স্যরি স্যার’। সামসুল হক লেখেন, ‘কলেজে দেখেছি তো’। উত্তরে শিক্ষার্থী লেখেন, ‘না স্যার। স্যরি। নেই স্যার। মাফ করবেন’। এরপর সামসুল হক লেখেন, ‘ওকে, সামনেই দেখবো। অনেক অনেক অনেক ভালো থেকো। বাই’।

অপর পাশের ছাত্রী লেখেন, আপনিও ভালো থাকবেন, বাই।

আরেকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, অধ্যক্ষ সামসুল হক লেখেন, ‘নতুন বউ এর সাজে দেখা করলে না?’। উত্তরে ছাত্রী লেখেন, ‘স্যার ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। স্টল থেকে বের হওয়ার সময় পাইনি। আজকে আমাদের স্টলে সবচাইতে বেশি সেল হইছে’। এরপর সামসুল হক লেখেন, ‘আমি তোমার বিউটি থেকে বঞ্চিত হলাম’। ফিরতি জবাবে ওই ছাত্রী লেখেন, ‘কেন স্যার? দেখা হইছিল তো আপনার সঙ্গে। তবে আপনাকে অনেক অনেক থ্যাংক ইউ স্যার। এত সুন্দর একটা আয়োজন করার জন্য। আমরা অনেক এনজয় করেছি’। আবার সামসুল হক লেখেন, ‘আমাকে দেখা দিলে আমিও করতাম’। এবার জবাবে ওই শিক্ষার্থী লেখেন, ‘স্যরি স্যার, আজকে খুবই ব্যস্ত সময় কেটেছে’। এবার সামসুল হক প্রশ্ন করেন, ‘কবে দেখা দিবে ওই একই সাজে?’

ভাইরাল হওয়া আরেক স্ক্রিনশটে দেখা যায়, এক ছাত্রীর ফেসবুকের স্টোরিতে ‘অতীব চমৎকার’ লিখে প্রশংসা করেছেন সামসুল হক। ওই শিক্ষার্থী একটি হিন্দি গান সেট করে লেখেন, ‘কিছু মানুষের সাথে দূরত্ব হওয়া ভীষণ দরকার’। রিপ্লাই দেন সামসুল হক। তিনি ওই শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করে লেখেন, ‘আমি কি তার মধ্যে?’।

তবে এসব কথোপকথনের বাক্য বিনিময় কবে হয়েছে সেই বিষয়ে জানা যায়নি। এবং এসব বিষয়ে কোনো ছাত্রীই মুখ খুলতে নারাজ।

এদিকে “একাডেমিক ভবনে লেখা আছে জ্ঞানই শক্তি আর প্রশাসনিক ভবনে লেখা আছে শিক্ষার জন্য এসো সেবার জন্য বেরিয়ে যাও” এই আশায় শিক্ষার্থীরা আসছেন পড়াশোনা করতে। অভিভাবক নির্দ্বিধায় পাঠিয়ে দিচ্ছে তার সন্তানকে।

কিন্তু কলেজে এসে যদি কোনো মেয়ে শিক্ষার্থীকে তার পিতা সমতুল্য শিক্ষকের কাছ থেকে বাজে মন্তব্য শুনতে হয়, তাহলে সেই কলেজের প্রতি সকলের একটা খারাপ ধারণার সৃষ্টি হবে। কমে যাবে শিক্ষার মান, নষ্ট হবে পরিবেশ।

তাই অধ্যক্ষ সামসুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা স্ক্রিনশটে ছাত্রীর ওড়না ছাড়াসহ বিভিন্ন সাজে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করার ভাইরাল হওয়া স্ক্রিনশটগুলো যাচাই সাপেক্ষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়ে এদিন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মানববন্ধন করেন।

এরপর কলেজ কলেজ কর্তৃপক্ষ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা সমাধানে বসেন। কিন্তু সেখানে সমাধান না হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি আরমান হোসেন জানান, অধ্যক্ষ আমাদের দাবির আশ্বাস দিলে আমরা সেখানে বসতে রাজি হয়। কিন্তু কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নোটিশ দিয়ে জানতে চাইবে। মেজরিটি শিক্ষার্থী যদি পদত্যাগ চায় তাহলে সে পদত্যাগ করবে।

আরমান বলেন, তাদের সাথে বারবার মশকরা করছে কলেজ প্রশাসন। প্রথমে অধ্যক্ষ পদত্যাগ করতে চাইলেও সেখানে আর কোনো পদত্যাগের কথা নেই। তারপরও আমরা বলেছি গণভোটের আয়োজন করতে। সেখানে শিক্ষার্থীরা যদি পদত্যাগ চায়, তাহলে তাঁকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। আমরা আর কলেজ প্রশাসনের তালবাহানা মেনে নিব না। অধ্যক্ষের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই।

এদিকে মোটামুটি একটা সমাধান হয়েছে বলে জানালেন সদর থানার ওসি নুরে আলম সিদ্দিকী।

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন- নওগাঁ জেলা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মিজানুর রহমান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি আরমান হোসেন, শিক্ষার্থী সাদনান সাকিব, শহীদ ফাহমিনের মা কাজী লুলুন মাখমিম (শিল্পী), কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জুনায়েদ হোসেন জুন ও এক ছাত্রের বাবা গোলাম রসুলসহ অন্যরা। মানববন্ধনে কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

জুনায়েদ হোসেন জুন, মিজানুর রহমান, কাজী লুলুন মাখমিম (শিল্পী) ও গোলাম রসুল বলেন- নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সামসুল হক। যিনি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে নারী শিক্ষার্থীদের সাথে আপত্তিকর কথোপকথন করাসহ এবং ওড়না ছাড়া ছবি দেয়ার জন্য বলেন। এসব বিষয় কাউকে জানানো হলে কৌশলে তাদের হুমকিও দেয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়। এছাড়া কোন শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করলে কলেজ প্রশাসন দিয়ে মারধর করা হয়। এছাড়া কলেজে ভর্তিসহ বিভিন্ন অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নেয়া হয়। কলেজে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সহ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবী জানানো হয়।

ছাত্র প্রতিনিধি সাকিব ও শাওন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, একজন অধ্যক্ষ হয়ে কিভাবে তিনি ছাত্রীদের সাথে কুচুরিপূর্ন মন্তব্য করতে পারেন। কিভাবে ছাত্রীর কাছ থেকে ওড়না ছাড়া ছবি চাইতে পারেন। এমন অধ্যক্ষের কাছে কিভাবে ছাত্রীরা নিরাপদ হতে পারে। কেন শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে যায়না বা কলেজে আসে না সে বিষয় নিয়ে তিনি কখনো ভাবেননি। তিনি শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি। অর্থ কিভাবে আত্মসাত করা যায় তা নিয়ে ভাবেন। আপত্তিকর মন্তব্য করায় অধ্যক্ষের শাস্তির দাবী করছি। আজ এর শেষ দেখে ছাড়বো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একই ভাবে এসব লেখা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেন শাওন নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমরা বেশকিছু দিন থেকে স্যারের একটা চ্যাটলিস্ট দেখছি। এটা সকলের জন্য দুঃখজনক। কারণ এই কলেজের প্রত্যেকটি ছাত্রী কলেজের শিক্ষকদের কাছে মেয়ে সমতুল্য। এরকম ঘটনা আমরা কখনোই আশা করিনা।

উল্লেখ, এর আগে কলেজ কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে পরীক্ষার ফি বৃদ্ধি করলে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছুদিন থেকে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করে আসছে। এমনকি প্রতিবাদ করতে গিয়ে কলেজ ছাত্রদল নেতা জুনায়েদ হোসেন জুন মারপিটের শিকার হয়।

সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: সামসুল হক জানান, আমার চাকরি থাক আর না থাক। আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি না।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print