ডিসেম্বর ১, ২০২৫ ১২:২৭ অপরাহ্ণ

পরিকল্পনাবীহিন আয়োজন করা

থমকে গেছে যানজট নিরসণের উদ্যোগ; আবারও অবৈধ যানবাহনের দখলে শহরের রাস্তা

শস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁ। আয়তনে এই জেলাটি রাজশাহী বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তবে শহরটি খুব ছোট ও যানজটযুক্ত। এক সময় শহরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া প্রধান সড়কসহ অন্যান্য অভন্তরীণ রাস্তাগুলো ছিলো সরু। তখন অভ্যন্তরীণ যানবাহনের সংখ্যাও ছিলো অনেক কম। কিন্তু বর্তমানে প্রধান সড়কসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো প্রশস্ত হলেও অপরিকল্পিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে অভ্যন্তরীণ বাহন। বিশেষ করে অবৈধ ব্যাটারী চালিত টমটম ও রিক্সা। আর এতেই প্রতিদিন বাড়ছে যানজট।

যার কারণে শুক্রবার ব্যতিত প্রায় প্রতিদিনই শহরে চলাচলকারীদের তীব্র যানজটের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে শহরের প্রবেশদ্বার ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে তাজের মোড় দিয়ে লিটন ব্রিজ পার হয়ে বাটার মোড়, চুড়ি পট্রি, গোস্তহাটির মোড়, মুক্তির মোড়সহ অন্যান্য প্রধান প্রধান স্থানগুলোতে প্রায়ই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়ে থাকে। নগরবিদরা যানজটের প্রধান কারণ হিসেবে অপরিল্পিত ভাবে চলাচলকারী অবৈধ ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও টমটমগুলোর আধিপত্যকে দায়ী করছেন। অথচ বছরের পর বছর পার হলেও প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে শহরকে যানজট মুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অজানা কারণে তা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কর্মকান্ড শহরবাসীর চোখে পড়েনি। তাই আবারও ভেস্তে গেল যানজট নিরসণের জন্য নেওয়া উদ্যোগটি।

সম্প্রতি নওগাঁ শহরের যানজট নিরসণ ও শৃঙ্খলা ফেরাতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, পৌর কর্তৃপক্ষ ও রিক্সা মালিক-শ্রমিকদের যৌথ উদ্যোগে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছিল। এতে শহরে শৃঙ্খলা ফেরার পাশাপাশি যানজট মুক্ত শহর পাওয়ার আশায় ছিলেন নওগাঁবাসী। এই জন্য আয়োজন করে গত ২০২৪ সালের ২১নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) দুপুরে অভিযানের উদ্বোধন করেন নওগাঁ পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকারের উপ পরিচালক টি.এম.এ মমিন। এ সময় নওগাঁ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, নওগাঁ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী, নওগাঁ জেলা ট্রাফিক পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক আফজাল হোসেন ও অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

অভিযানের অংশ হিসেবে শহরে প্রবেশের প্রধান আটটি প্রবেশদ্বারে চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল। চেক পোষ্টগুলোতে পুলিশ সদস্য, ছাত্র প্রতিনিধি, রোভার স্কাউট সদস্য ও রিক্সা মালিক শ্রমিক প্রতিনিধিসহ মোট ১২জন করে কাজ করেছিলেন। প্রতিটি মোড়ে অনিবন্ধিত যানবাহনগুলো চেক করা হচ্ছিল। পৌরশহরের বৈধ কাগজপত্রাদি না থাকলে সেই সব ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও টমটমগুলোকে শহরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছিল না।

এতে করে শহরের অভ্যন্তরীণ যানজট অনেকাংশই কমেছিল। কিন্তু ভোগান্তি বেড়েছিল জনসাধারণের। আর প্রতিবাদমুখী হয়ে উঠেছিল পৌর শহরের বাহিরের ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও টমটমগুলোর চালক-মালিকরা। তারা শহরে যেমন ঢুকছিল না, ঠিক তেমনি শহরের কোন গাড়িকে ইউনিয়নে ঢুকতে দিচ্ছিল। মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল নওগাঁ পৌরসভার গাড়ির সাথে, জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ সকল ইউনিয়নের গাড়ির মালিক-চালক ও পাশ্ববর্তী বগুড়ার সান্তাহার পৌরসভা এবং জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার গাড়ির মালিক-চলকরা। অপরদিকে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও টমটমগুলোর চালক-মালিকদের মাঝে। এরপর আর এগোয়নি উদ্যোগটি। বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে যানজট নিরসণের উদ্যোগ। গত একসপ্তাহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে যানজটের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও ভূল পথে গাড়ি নিয়ে যেতেও লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে মোটরসাইকেল চালকরা। আবার হুট করে হান্ডেল বাঁকা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অদক্ষ রিক্সা চালকরা এগিয়ে। ফলে দূর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তাই বর্তমানে শহরের রাস্তাগুলো আবারও দখলে রেখেছে অবৈধ রিক্সাগুলো।

অটো চালক আরমান দশ বছর থেকে গাড়ি চালাচ্ছেন। তিনি ক্ষোভ নিয়েই বললেন, পরিকল্পনা ছাড়া কোন উদ্যোগ নিলে সেটা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভবনা বেশি। এছাড়া পৌরসভার লাইসেন্স নিতে অনেক বেশি টাকা লাগে আর ইউনিয়নে লাগে খুব কম। তারপরও ইউনিয়নের লাইসেন্সের মর্যাদা বেশি। আর যানজট নিরসণের জন্য সকল গাড়িকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। একদিন লাল গাড়ি চলবে, আরেকদিন চলবে সবুজ গাড়ি, তাহলে যানজট অনেক কমে যাবে বলে মতামত দিলেন তিনি।

যানজট নিরসণের জন্য আরেকটি উপায় হলো যেখান থেকে গাড়ি জন্ম নিচ্ছে (তৈরি হচ্ছে) সেখানেই বন্ধ করতে হবে। নতুন করে কোন গাড়ি বের হতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই যানজট নিরসণ সম্ভব। এভাবেই তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলেন অটো গাড়ির মালিক শহিদুল ইসলাম। তাছাড়া গাড়ির দাম যতোই হোক, এক লাখ টাকা দিলেই একটা গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। কারণ বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই অনেকে কিস্তিতে গাড়ি কিনছে। বললেন সম্রাট নামের এক চালক।

মাসুদ নামের এক টমটম চালক জানালেন, লাইসেন্স বাবদ একসময় নেওয়া হয়েছিল ২২০০ টাকা, পরে নেওয়া হয়েছে ১৮০০ টাকা। তিনি আরও জানালেন, রিক্সার চালকরা যেন নিয়মের মধ্যে গাড়ি চালায় সেইজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে জরিমানার আওতায় আনতে হবে। কারণ তারা ইচ্ছেমতো গাড়ি চালায়, যখন খুশি যেখানে সেখানে হান্ডেল বাঁকা করে দেয়।

অটোরিক্সা (বউ সোহাগি) গাড়ির চালক উজ্জ্বল জানালেন, আমার কাছ থেকে গাড়ি ও চালক বাবদ ১৬০০ টাকা নেওয়া হয়েছে এবং ড্রেসের জন্য চাওয়া হয়েছিল ৩৫০ টাকা। আরেক বউ সোহাগি গাড়ির চালক বললেন গাড়ির লাইসেন্স বাবদ ১২০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। দুবলহাটির এক চালক জানালেন, তার কাছ থেকে গাড়ি ও চালক বাবদ ১৪০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। আর ড্রেস বাবদ ২৮০ টাকা চেয়েছিল, সেটা আমি নিইনি। তবে আমার এক পরিচিত লোক করে দিয়েছে।

অনেক চালকের দাবি, মাত্র তিন-চার দিন অভিযান চলার পর বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিক নেতারা বসে কিভাবে সমাধান করেছে আমাদের জানা নেই। তবে কারো কারো ধারণা কিছু গাড়ির লাইসেন্সের জন্যই তারা এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। আবার কেউ কেউ বলছেন, এখন দলীয় কোন সরকার নেই। তাই এই সময়ে যদি যানজটমুক্ত করতে না পারে, তাহলে রাজনৈতিক সরকারের সময়ে আর পারবেনা।

এছাড়া নওগাঁ পৌরসভার লাইসেন্স করতে লাগে বেশি টাকা। তাই কেউ কেউ কৌশলে চালকের লাইসেন্স করে নওগাঁ পৌরসভা থেকে আর গাড়ির লাইসেন্স করে অন্যান্য জায়গা থেকে। তবে পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী নিজেরা বেশি টাকা না নিলেও বাহিরে কারো মাধ্যমে করতে আসলে বেশি টাকা লাগে বলে স্বীকার করেছেন। এদিকে চালকদের জন্য কেনা ড্রেসগুলো ঘরের মধ্যে বস্তায় স্তুপ করে সাজানো আছে। তবে কতো টাকার কতোগুলো ড্রেস কেনা হয়েছে এবং যানজট নিরসণের জন্য নেওয়া উদ্যোগের জন্য কতো টাকা খরচ হয়েছে সেই বিষয়ে কেউ মুখ খুলছে না। ফলে কতো টাকা গচ্চা গেল এবিষয়ে সরেজমিনে গিয়েও জানতে পারেনি এই প্রতিবেদক। এমনকি মুঠোফোনে জানতে চাইলেও জানানো হয়নি।

নওগাঁ পৌরসভার যানবাহন লাইসেন্স পরিদর্শক নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে তিন হাজারের বেশি লাইসেন্স দেওয়া যাবেনা। শহরে বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ৩হাজার। কিন্তু প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১৫ হাজার রিক্সা ও ব্যাটারিচালিত বিভিন্ন যানবাহন শহরে প্রবেশ করে। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আর পৌরসভার গাড়ির লাইসেন্স বাবদ এক হাজার টাকা, চালক ২৫০ ও ড্রেস বাবদ ২৫০ টাকা মোট ১৫০০ টাকা। আর টমটম গাড়ির লাইসেন্স বাবদ ১২০০, চালক ২৫০ ও ড্রেস ২৫০ মোট ১৭০০ টাকা। যা আগে ছিল ২০৮৫ টাকা। তবে এ পর্যন্ত কতোজনকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। কেন ভেস্তে গেল এবিষয়ে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখন শিথিল আছে বলে জানান তিনি।

নওগাঁ পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার কবির বলেন, এই বিষয়টি পৌর প্রশাসক ভালো বলতে পারবেন। আর আমাদের যানজট নিরসণের উদ্যোগ এখনও চলমান আছে। এগুলো থামার কোন প্রক্রিয়া না, সবসময় চলমান থাকে। ২০০৯ সালের আগে ৬হাজার অটো রিক্সা গাড়িকে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। গ্যাপ দিয়ে আমাদের কার্যক্রম এক সপ্তাহ চলেছে। প্রতিটি পয়েন্টে থাকা লোকজনের একটা খরচ আছে, যেগুলো প্রতিদিন করা সম্ভব না। তবে কতো টাকা খরচ হয়েছে জানতে চাইলে যানবাহন শাখায় খোঁজ নিতে বলে এড়িয়ে গেলেন তিনি।

নওগাঁ জেলা ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা (টমটম) মালিক সমবায় সমিতিরি সভাপতি মাহাবুব হাসান পল্টু মুঠোফোনে বলেন, পরিকল্পনা করে যানজট নিরসণের উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে নওগাঁয় আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা রিক্সার কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। একটা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পৌরসভায় আমাদের টমটম গাড়ি চলে মাত্র ৫০০ টি। আর নির্দিষ্ট করে বিভিন্ন স্থান থেকে উপজেলায় চলে প্রায় তিন হাজার গাড়ি। আর রিক্সার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড। প্রায় প্রতিটি মোড়ে মোড়ে তাদের নের্তৃত্ব থাকে। তবে যানজট নিরসণে আমরা যেকোনো ধরণের সহযোগীতা করতে প্রস্তুত আছি বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে নওগাঁ পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকারের উপ পরিচালক টি. এম. এ মমিন মুঠোফোনে বলেন, এক সপ্তাহ অভিযান চলেছে। আর যানজটের জন্য কি কি সমস্যা আছে সেগুলো আপনারা তুলে ধরেন। ড্রেসগুলো পৌরসভায় পড়ে আছে এমন বিষয় না, চালকরা নবায়ন করতে আসলে দেওয়া হবে। তবে পৌরসভাকে নিয়ে দৃশ্যমান কিছু ভাল কাজ করা হয়েছে। আর কারো গাফিলতি ও টাকা বেশি নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে নওগাঁ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার মুঠোফোনে বলেন, যানজট নিরসণের জন্য সকলের প্রচেষ্টা জরুরি। বিভিন্ন অংশীজনের মাধ্যমে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে কিভাবে দ্রæত উত্তোরণ করা যায় সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমি আমার টিমের মাধ্যমে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর যানজট নিরসণের জন্য ট্রাফিক পুলিশ যথাযথভাবে মুভমেন্টে থাকে, কেউ যেন রাস্তাঘাট বøক করতে না পারে সেই জন্য সর্বদা সচেষ্ট আছে। তারপরও কেউ যদি দায়িত্বে অবহেলা করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, জরিমানার চাইতে একজন চালক যদি নিজে সচেতন হয়, সেটা সকলের জন্য ভালো হয়। আর চালককে যানবাহনের শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের মোটিভেশন করতে হবে। যদি সুফল ও কুফল বোঝানো যায়, তাহলে সকলের জন্য ভালো হবে। মোটিভেশনের পর যে সমাধান হবে, সেটার স্থায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদী হয়। শুধুমাত্র শাস্তি বা জরিমানা করে সমস্যার সমাধান করা যায়না। এছাড়া যারা গাড়ি চালায়, তাদেরও একটা নাগরিক দায়িত্ব হলো রাস্তাঘাট বøক করে না রাখা।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print