ডিসেম্বর ১, ২০২৫ ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ

দেনমোহর বাড়িয়ে জোরপূর্বক কাবিননামায় স্বাক্ষর করানো হয় রাবি শিক্ষককে 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহাবুর রহমান সম্প্রতি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তিনি শুধু পারিবারিক অপমানেরই নয়, বরং সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকারও হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তার ওপর দেওয়া হয়েছে মিথ্যা অভিযোগ, ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিভ্রান্তিকর তথ্য।

ঘটনার সূত্রপাত

মো. মাহাবুর রহমান প্রায় দুই বছর আগে বিয়ে করেন শারমিন আক্তার আসমাকে (২৩)। আসমা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০২০–২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং তানোর পৌরসভার ধানতোর গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতা আয়েশ উদ্দিন বাবু একজন কৃষক।

বিয়ের পর আসমা স্বাভাবিকভাবে স্বামীর বাসায় বসবাস করতেন এবং উভয় পরিবারের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তবে দেনমোহর ও আরো কিছু বিষয় নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধ সৃষ্টি হয়। মাহাবুর রহমান তার সামর্থ্য অনুযায়ী উপযুক্ত দেনমোহর নির্ধারণ করেন ও তা নগদে পরিশোধ করেন। শ্বশুর আয়েশ উদ্দিন তা মেনে নিতে না পেরে পরবর্তীতে দেনমোহর বাড়িয়ে কাবিননামায় নতুন করে স্বাক্ষর করানোর ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।

এছাড়া, শ্বশুর আয়েশ উদ্দিন কৃষিকাজ ও গরুর খামার স্থাপন, এবং বন্ধকি (কট) জমি ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে অর্থসাহায্য চান। এই অর্থ না-পেয়ে তিনি জামাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হন।

বর্তমান ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে তিনি রাজশাহীর ধানতোর এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে যান। শ্বশুর পক্ষ আগেই ফোনে তাকে জানিয়েছিল তার স্ত্রী শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, কথা বলতে পারছেন না। কিন্তু তাদের বাড়ির গেটে পৌঁছেই তিনি শ্বশুরের দ্বারা অপমানিত হন। এর কিছু সময়ের মধ্যেই স্থানীয় মাস্তান শ্রেণীর লোকজন জড়ো করে তাকে জিম্মি করা হয়। সাথে কাজী ডেকে হুমকি ও হেনস্তার মুখে দেনমোহর বৃদ্ধি করে কাবিননামায় স্বাক্ষর করানো হয়।

ঘটনার বিস্তারিত

শ্বশুরবাড়ির গেটে পৌঁছেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তিনি। গেটেই শ্বশুর বলেন, “তুমি কেন এসেছ?”—যদিও এর আগে ফোনে তিনিই আসতে বলেছিলেন। এরপর শ্বশুর তাকে বসতে বলেন এবং প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি—হালিম, আনারুল, জসিমসহ প্রায় ১৫–২০ জন—ঘটনাস্থলে জড়ো করেন।

একপর্যায়ে সাংবাদিক মো. বকুল হোসেন, দেলোয়ার হোসেন সোহেল ও সাইদ সাজু উপস্থিত হন। মো. মাহাবুর রহমানের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং কাজীকে দিয়ে দেনমোহর বাড়িয়ে নতুন করে কাবিননামায় জোর করে স্বাক্ষর করানো হয়, যা ভুক্তভোগীর মতে সম্পূর্ণ বেআইনি ও মানসিক চাপে আদায় করা।

এরপর তাকে বাড়ির ভেতরে একটি কক্ষে আটক করে রাখা হয়। বাড়ির বাইরে ও ভেতরে সাত–আটজন লোক দিয়ে পাহারা বসানো হয়, যাতে তিনি বেরিয়ে যেতে না পারেন। পুরো রাত ও পরদিন দুপুর পর্যন্ত তিনি সেখানে কেবল পানি পান করে কাটান।

ভিডিও ধারণ ও ব্ল্যাকমেইল

ঘটনার সময় সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে জনাব মাহাবুরকে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়। একা এবং ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে পড়ায় তিনি অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি বা দিতে চাননি। এসময় সাংবাদিক মো. বকুল হোসেন ভিডিও ধারণ করেন এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করেন (শ্বশুর আয়েশ উদ্দিন সেসময় এমন আচরণ করেন যেন তার মেয়ের জামাইকে তিনি আর চেনেন না। যদিও সেদিনই দুপুরে তিনি মেয়ের গুরুতর অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে জামাইকে বাবা বলে সম্বোধন করেন এবং বাসায় দেখতে আসতে বলেন)। এরপর সেই ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে তাকে দুর্বল, অপরাধীসুলভ ও বিব্রত অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়। অনেকেই এই ঘটনাকে ‘সাংবাদিকতার নামে ব্ল্যাকমেইলিং’ আবার অনেকে সাইবারক্রাইম আখ্যা দিয়েছেন।

প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও মুক্তি

পরদিন সকালবেলা মাহাবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও কয়েকজন সহকর্মীকে বিষয়টি জানান। প্রক্টরের পক্ষ থেকে তানোর থানায় যোগাযোগ করার পর পরিস্থিতি বুঝতে পেরে শ্বশুরপক্ষ তার কাছে একটি এফিডেভিটে স্বাক্ষর করিয়ে দুপুরে ছেড়ে দেয়। ফারসি বিভাগের শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী জনাব মাহাবুর রহমান ওইদিন আমাকে কল করেন। তানোরে তার শ্বশুরবাড়িতে তাকে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। দ্রুত আমরা আরো কয়েকজন সহকর্মীসহ গিয়ে প্রক্টরকে বিষয়টি অবহিত করি ও সহকর্মীকে উদ্ধার করার জন্য পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করি।

মাহাবুর রহমানের বক্তব্য

মাহাবুর রহমান জানান, আমি আমার দুই বছর আগে বিয়ে করা বউয়ের বাসায় গিয়েছিলাম, তার অসুস্থতার সংবাদ শুনে। শ্বশুর কম দেনমোহর ও আরো কিছু কারণে আমার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। আমি আমার সাধ্যমতো দেনমোহর দিয়েছি। আমার সামর্থ অনুযায়ী বিয়ের সময়েই তা নগদে পরিশোধ করেছিলাম। উনি কাজী ডেকে দেনমোহর বৃদ্ধি করার কথা বলেন এবং মাস্তান লোকদের দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। দেনমোহর চার লাখ নির্ধারন করে আমার কাছ থেকে কাবিননামায় স্বাক্ষর নেন। একপর্যায়ে শ্বশুর সাংবাদিক ডেকে আনেন। ওখানে গিয়ে বুঝতে পারি আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলে আমাকে ধানতোরে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সাংবাদিক ডেকে ডিডিও করা পর্যন্ত সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত।

আমি যাওয়ার পরে দেখতে পাই আমার স্ত্রীকে সম্ভবত আটকে রাখা হয়েছে, উনারা বিভিন্ন মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলছিলেন আমার নামে।

তিনি আরও জানান, তার স্ত্রীকে সামনে হাজির করে সত্য যাচাইয়ের সুযোগও দেওয়া হয়নি। উপরন্তু, দুই-তিনজন নারী দিয়ে স্ত্রীর ঘরে পাহারা বসানো হয়, যাতে সে বাইরে এসে কিছু বলতে না পারে। তার অভিযোগ, উদ্দেশ্য ছিল তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা।

শ্বশুর ও মেয়ের বক্তব্য

এবিষয়ে শ্বশুর আয়েশ উদ্দিন বাবুকে ফোন করা হলে প্রথমে তিনি কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরে বলেন, “আমার মন্তব্য কিছু নাই। তুমি যেখান থেকে এই তথ্যগুলা জানিছো, এই জিনিসগুলা ওখান থেকে জানো। বিস্তারিত কিছু বলতে চাচ্ছি না।”

জানা যায়, স্ত্রী শারমিন আক্তার আসমা এখন তার বাপের বাড়িতেই অবস্থান করছেন। আয়েশ উদ্দিনের কাছে তার মেয়ের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, “তাকে দেওয়া যাবে না। আমি ওর অভিভাবক, আমার বক্তব্যই ওর বক্তব্য।”

ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও নেটিজেনরা

ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে অধ্যাপকের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, “একজন শিক্ষকের সঙ্গে এমন আচরণ শুধু ব্যক্তিগত অপমান নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মর্যাদার ওপর আঘাত।”

নেটিজেনদের মধ্যে অনেকে এবিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। মো. হৃদয় হাসান বলেন, “একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ওপর এমন মিথ্যে রটনার জন্য হেনস্তাকারীদের আইনের আওতায় আনা হোক।”

তানোরের সাংবাদিক সারোয়ার হোসেন তুষার বলেন, “এরজন্য দায়ী স্থানীয় কৃষক দলের নেতা আনারুল, হালিম গংরা।”

জেসমিন হক নামে একজন মন্তব্য করেন, “এইরকম অর্থলোভী শ্বশুর–শাশুড়ির অভাব নাই এদেশে! সুতরাং যথোপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে শিক্ষককে অপমান, অবমাননা ও হুমকি ধামকির জন্য তাদের আইনের আওতায় নেওয়ার জোর দাবি জানাই।”

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এই ঘটনার মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়নের একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে—যা শুধু ব্যক্তির নয়, সমাজেরও বিবেককে

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print