বগুড়ার ধুনটের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্তের বিরুদ্ধে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাত সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত টিম ইতি মধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছেন।
গত ৫ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে আশ্রায়ন প্রকল্পে লুটপাটে ইউএনও একাই একশ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর দুদক নড়েচড়ে বসে এবং অনিয়ম দুর্নীতির অনুসন্ধানের জন্য টিম গঠন করা হয়। অনুসন্ধান টিমের প্রধান উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম গত ৭ জুলাই ধুনট উপজেলায় নির্মান করা আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ সংক্রান্ত রেকর্ড ও তথ্য সরবরাহ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে আশ্রায়ন প্রকল্পের বরাদ্দ পত্র, প্রকল্প গঠনপত্র, প্রকল্প কমিটির সভার রেজুলেশন, প্রকল্পের নকসা, বিল ভাউচার,পরিমাপ বই, প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন, নথির নোটশীট, নির্মিত ঘর বরাদ্দের আবেদন, আবেদনকারীগনের তালিকা, চুড়ান্ত বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিগণের তালিকা ও ঘর হস্তান্তরপত্র ও সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি সহ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সকল কর্মকর্তার নাম, পদবি, কর্মস্থল (সাবেক ও বর্তমান) স্থায়ী ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর চাওয়া হয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২০২১ ও ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ‘মন্ত্রী মজিব বর্ষের উপহার হিসেবে উপজেলার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুর্নবাসনে দুর্যোগ সহনীয় বিশেষ আশ্রায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এই উপজেলায় তিন ধাপে ৩৯৯টি ঘর নির্মাণের জন্য ৭ কোটি ৯৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউএনও সভাপতি, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব, সহাকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা রেখে বিশেষ আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করার সরকারী নীতিমালা থাকলেও সাবেক ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্ত একাই যেন তেন ভাবে সরকারী অর্থ খরচ করে আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ ও বরাদ্দ প্রদান করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, আশ্রায় প্রকল্পের ঘর নির্মাণ ও বরাদ্দের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাবেক এই নির্বাহী কর্মকর্তা। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে ৩৯৯টি ঘরের মধ্যে ২৬১টি ঘর বরাদ্দের সুবিধাভোগীদের নাম তালিকা সরবরাহ করা হলেও বাকী ঘর নির্মাণ ও বরাদ্দ হয়েছে কিনা কিংবা ওই সব ঘরে কারা কিভাবে বসবাস করেছে তার কোন তথ্য উপাত্ত নেই উপজেলা প্রশাসনের কাছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশ্রায়ন প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরের দেয়াল ফেটে গিয়েছে। প্লেষ্টারা উঠে গেছে এবং জানালা দরজা ভেঙ্গে গিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বেশীর ভাগ ঘরেই তালা ঝুলছে বছরের পর বছর ধরে। রাশেদা খাতুনের পাকা ঘরবাড়ি থাকার পরেও আশ্রায় প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ নিয়ে তালা বন্ধ রেখেছেন।
এছাড়াও আজিজাল ফকির, লুলু মিয়া, পুর্নিমা রানী, হামিদুল ইসলাম সহ অনেকে ঘর বরাদ্দ নেওয়ার পর থেকেই তালা বদ্ধ রেখেছেন। আশ্রায়নের ঘরে যারা বাস করছেন তাদের অনেকেরই নামে কোন দলিল পত্র নাই।
চুনিয়াপাড়া আশ্রায়নের ঘরে বসবাস করা মিনি খাতুন জানান, ইউএনও সঞ্জয় স্যার আমাকে ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন কিন্ত বেধ কোন কাগজপত্র দেননি।
চায়না খাতুন জানান, ইউএনও স্যার ৫ বছর আগে আমাকে ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন কিন্ত আমি এখন পর্যন্ত কোন কাগজপত্র পাইনি। রেহানা, জুলেখা, শিউলি ও নাসিমা মতো অনেকেই ঘর বরাদ্দের কোন কাগজপত্র পাননি।
আশ্রায় প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্তের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সদস্যরা।
মথুরাপুর এলাকার এস.এস.এস ইটভাটার মালিক শাহ আলী জানান, সাবেক ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্ত মোবাইল ফোনে তার নিকট থেকে আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মানের জন্য ৬০ হাজার ইট চেয়ে ছিলেন। সে সময় ভাটায় কোন ইট না থাকায় তিনি ইট দিতে না পারায় ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন।
একই এলাকার জননী ইটভাটার মালিক আব্দুল আলিম বলেন, আমার ভাটা থেকে ইট নিয়ে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেননি।
জোড়খালি এলাকার ইটভাটা মালিক শামসুল বারী জানান, ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্ত তার ভাটা থেকে ইট নিয়ে ৩ লাখ টাকা না দিয়েই অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন।
রামনগর এলাকার বালু ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্ত ১০০ ট্রাক বালু নিয়ে তাকে কোন টাকা পয়সা দেন নাই।
ধুনট পৌর এলাকার জিঞ্জিরতলা গ্রামের ট্রাক ব্যবসায়ী সাবেদ আলী সরকার বলেন, বালু পরিবহন করে ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্ত ট্রাক ভাড়ার ২৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেননি।আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণের একটি কমিটি থাকলেও সাবেক ইউএন সঞ্জয় কুমার মহন্ত একই সকল কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আব্দুল আলীম বলেন, আশ্রায় প্রকল্পের ঘর নির্মানে সকল কাজ ইউএনও স্যার একাই করেছেন। অনেকটা চাপের মুখে শুধু টাকা উত্তোলনের জন্য কাগজ পত্রে ও চেকে আমাকে স্বাক্ষর দিতে হয়েছে।
সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল সাজ রিজন জানান, আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ কমিটির আমি সদস্য ছিলাম কিনা তা জানি না।
ধুনট সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান লাল মিয়া, গোপালনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন সরকার, চিকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জুয়েল, গোশাইবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল হক বাচ্চু, মথুরাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসান আহম্মেদ জেমস জানান, ঘর নির্মান ও ভূমিহীনদের মাঝে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।