মে ১৩, ২০২৪ ৯:২৯ এএম

বগুড়ায় সাগর-হযরত আধিপত্যের লড়াই ও পারভেজ খুন

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত সাগর ও হযরত। অভিযোগ আছে, তাদের এ লড়াইয়ে সম্প্রতি খুন হন শাহজালাল তালুকদার পারভেজ। তার আগে ছুরিকাঘাতের শিকার হন পারভেজের বড়ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার পান্নুও। পারভেজের খুনের নেপথ্যে দায়ী করা হচ্ছে তার আত্মীয় সাগর তালুকদারকে। তবে খুন হওয়ার আগে নিহত পারভেজ অভিযুক্ত সাগরকে খুন করার পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন বলেও উঠেছে অভিযোগ।

এমন ঘটনা বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায়। সাগর হোসেন তালুকদার ওই উপজেলার সাবরুল গ্রামের বাসিন্দা। জেলা-উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়।
তবে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ভিপি সাজেদুর রহমান শাহীন বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে সাগরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

নিহত পারভেজ সাবরুল এলাকার বাসিন্দা এবং বগুড়া কৈচর বিএম টেকনিক্যাল অ্যান্ড কারিগরি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। তিনি অভিযুক্ত সাগর তালুকদারের চাচা (বাবার চাচাতো ভাই)।

আর হযরত আলী শাজাহানপুরের রানীরহাট বয়রাদীঘি গ্রামের বাসিন্দা। উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তিনি। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক হয়েও হযরত আলী নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আনারস প্রতীকে নির্বাচিত হন তিনি। এরপরই সাগরের সঙ্গে হযরত পুরনো দ্বন্দ্ব ফিরে যান। এরমধ্যেই খুন হলেন শাহজালাল তালুকদার পারভেজ।

এদিকে, গত ১৩ আগস্ট এক মামলায় আত্মসমর্পণ করে বর্তমানে কারাগারে আছেন সাগর।

নিহত পারভেজের স্বজনদের অভিযোগ, সাগরের লোকজন তাকে খুন করেছে। আর জেলে বসেই এই হত্যার হুকুম দেন সাগর।

যেভাবে খুন হন পারভেজ

গত ২ সেপ্টেম্বর (শনিবার) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বগুড়া শহরের দিকে যাচ্ছিলেন পারভেজ। পথে মাথাইলচাপর এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিশায় থাকা কয়েকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে তার ওপর হামলা চালান। ওই সময় জীবন বাঁচাতে মোটরসাইকেল ফেলে দৌঁড়ে এক বাড়িতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন পারভেজ। সেখানেই হামলাকারীরা তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলেন এবং কুপিয়ে চলে যান। এসময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে পারভেজ গুরুতর জখম হন এবং তার ডান হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

২ সেপ্টেম্বর রাতে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শাজাহানপুর থানায় মামলা করেন নিহতের স্ত্রী শামসুন্নাহার। মামলায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে আরও ৪-৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।

এ মামলার প্রধান আসামি ইমন বাবুসহ (২০) এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া ইমন বাবু সাগরের ভাগনে।

হত্যার দায় স্বীকার করা চারজন হলেন- সাবরুল এলাকার বাসিন্দা সাব্বির (২৮), আরিফ হোসেন (২০), কাউছার (২০) ও বগুড়া সদরের শিববাটি কালিতলা এলাকার আল আমিন (২৬)। আল আমিন এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন না। মামলার তদন্তে তার নাম পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, পারভেজ হত্যার ঘটনায় তদন্ত চলছে। সাগরকে আসামি করা হবে কিনা তা তদন্তে জানা যাবে। হত্যার দায় স্বীকার করে চারজন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা কী বলেছেন-তদন্তের স্বার্থে এখনই তা বলা যাবে না।

সাগর ও পারভেজের দ্বন্দ্বের শুরু

বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। সাবরুল বাজার কমিটির উদ্যোগে বনভোজনের আয়োজন করা হয়। বাজারের সব ব্যবসায়ী চাঁদা দিলেও দেননি সাগর হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। তবে তিনি সাবরুলের সাগর নন। তিনি পার্শ্ববর্তী মাথাইলচাপর গ্রামের বাসিন্দা সাগর। তিনি আশেকপুর ইউপি চেয়ারম্যান হযরতের ফুফাতো ভাই।

বনভোজনের টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে বাজারের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব রুবেলের ওপর চড়াও হন মাথাইলচাপরের এই সাগর। এক পর্যায়ে রুবেলকে মারধর (কিল-ঘুষি) করেন তিনি।

এ ঘটনার পরপরই উত্তপ্ত হয়ে উঠে সাবরুল বাজার এলাকা। বাজার কমিটির পক্ষ থেকে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এসবের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন বাজার কমিটির সভাপতি নিহত শাহজালাল তালুকদার পারভেজের বড়ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার পান্নু। মাথাইলচাপরের সাগরের বিরুদ্ধে তারা একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এর বিপরীতে মাথাইলচাপরের সাগর সাবরুলের সাগরের সঙ্গে এক হয়ে পান্নুর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন। এমনকি পান্নুর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে মাদক রেখে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টাও করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরবর্তীতে এসব ঘটনার জড়িয়ে পড়েন পারভেজ। এক পর্যায়ে মাথাইলচাপরের সাগর এ দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু পান্নুর সঙ্গে দ্বন্দ্ব থেকেই যায় সাবরুলের সাগরের।

এরই মধ্যে ২০২১ সালের ৩০ মে (রবিবার) সন্ধ্যায় সাবরুল বাজার এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সিহাব উদ্দিন বাবুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি শাজাহানপুর উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সিহাব সাবরুল গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। এ হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৩১ মে (সোমবার) রাতে নিহতের স্ত্রী রুমি বাদি হয়ে শাজাহানপুর থানায় মামলা করেন। মামলায় সাগরকে প্রধান আসামি করা হয়।

মামলাটির চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় নুরুজ্জামান তালুকদার পান্নুকে। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হন সাগর। যদিও পান্নু দাবি করেন তাকে না জানিয়েই মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। এক পর্যায়ে মাস দুয়েক আগে পান্নুকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছুরিকাঘাত করেন সাগরের সহযোগীরা। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগও করা হয়নি। সর্বশেষ খুন হলেন পারভেজ।

সাগর ও হযরত আধিপত্যের লড়াই

সাগর ও হযরতের আধিপত্যের দ্বন্দ্বটা অনেক পুরনো। আশেকপুর ইউনিয়নের রানীরহাট, সাবরুল ও এর আশপাশের এলাকায় ইট, বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল তাদের।

২০২২ সালে নভেম্বর মাসে আশেকপুর ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচনের সময় সাগর নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ইনছান আলীর পক্ষে কাজ করেন। এতে সাগরের ওপর আরও ক্ষিপ্ত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হযরত আলী। ওই সময় সাগরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন হযরত। এ কাজের জন্য সন্ত্রাসীও ভাড়া করা হয়েছিল। তবে বেঁচে যান সাগর। একই সঙ্গে ফাঁস হয়ে যায় সাগরকে হত্যা করতে হযরতের গোপন বৈঠকের কথা। সবকিছু জানতে পারেন সাগর। সাগর আরও জানতে পারেন হযরতকে সহায়তা করছিলেন পারভেজ। এরপর সতর্ক হয়ে যান সাগর।

সাগরের সহযোগীদের মধ্যে অধিকাংশই কিশোর সদস্য। নিজ এলাকায় ইট-বালুর ব্যবসায় করেন সাগর। তার নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে- এমন অনেক পরিবার আছে সাবরুলে। নিজ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চাচার দাদন ব্যবসায় সহযোগিতা করতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের হয়রানি করেন তিনি।

পারভেজ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া সাগরের চাচা উজ্জ্বল তালুকদার একজন দাদন ব্যবসায়ী। কেউ সময়মত সুদ ও আসল টাকা পরিশোধ না করলে তাকে সাগরের মাধ্যমে হুমকি দিয়ে থাকেন উজ্জ্বল। এসব কারণে গ্রাম থেকে পালিয়ে থাকেন অনেকেই।

ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী ছিলেন শাজাহানপুরের খুন হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী আবু হানিফ মিস্টারের সহযোগী। মিস্টার স্বেচ্ছাসেবক লীগের বগুড়া জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। শাজাহানপুরের শাকপালা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন তিনি।

মিস্টারের সহযোগী হিসেবে রানিরহাট ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন হযরত। ইট-বালুর ব্যবসায় করতেন তিনি। তখন থেকেই সাগরের সঙ্গে তার আধিপত্যের দ্বন্দ্ব শুরু। তবে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তার সহযোগী ও স্বজনরা ইট-বালুর ব্যবসায় করছেন। হযরত বর্তমানে সাবরুল ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এতেই সাগর ও তার দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সাগরকে সাবরুল এলাকা থেকে সরাতে পান্নু ও পারভেজের সঙ্গে যুক্ত হন হযরত।

পুলিশ জানায়, হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে ১২টি মামলা রয়েছে সাগরের বিরুদ্ধে। আর হযরতের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক আইনে ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৫টি মামলা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাগরের স্বজনরা জানান, ইউপি চেয়ারম্যান হযরতের চেষ্টা সাগরকে দমিয়ে রাখা। সাগর নিহত হলে বা না থাকলে রানীরহাট থেকে শুরু করে সাবরুলসহ আশপাশের এলাকা তার দখলে চলে যাবে। তখন শুধু হযরতের রাজত্ব চলবে আশেকপুর ইউনিয়নে।

তারা আরও জানান, সাগরকে হত্যার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী ভাড়া করা হয়েছিল। তারা সাগরকে হত্যা করার জন্য সাবরুল ও এর আশপাশে ঘোরাফেরা শুরু করেন। গোপন এক বৈঠকে সাগরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ইউপি চেয়ারম্যান হযরত। আর এ কাজে হযরতকে সহায়তা করছিলেন নিহত পারভেজ।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আশেকপুর ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী।

তিনি বলেন, সাগরের সাথে আমার কোন শত্রুতা ছিল না। আমি বা পারভেজ তাকে হত্যার পরিকল্পনাও করিনি।
পারভেজকে হত্যার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাবরুল বাজারে একটি বাড়ি কিনেছিলেন পান্নু। সেই বাড়িটা সাগরও কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গোপনে সেই বাড়ি কিনে নেন পান্নু। ওই বাড়ি কেনার পর তাদের কাছ থেকে চাঁদা চান সাগর। এছাড়া বাবু হত্যা মামলায় পান্নু সাক্ষী ছিলেন। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে সাগর পান্নুকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছুরিকাঘাত করেন এবং পারভেজকে হত্যার হুমকি দেন।

এনসিএন/এসকে

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print