মে ১৭, ২০২৪ ১:৫১ পিএম

শজিমেকে জনবল সংকটে ব্যাহত স্বাস্থ্যসেবা

বগুড়ার চিকিৎসাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের। দুর্ঘটনা কিংবা রোগ, শোকে বগুড়ার মানুষের প্রথম ভরসা শজিমেক হাসপাতাল। কিন্তু বগুড়াবাসীর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে হাসপাতালটি। এর প্রধান কারণ জনবল সংকট।

জনবল সংকটে ভোগান্তি নিয়েই চিকিৎসাসেবা প্রদান করে যাচ্ছেন ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যসেবীরা। হাসপাতালটিতে সর্বাধিক জনবল সংকট তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা এবং হাসপাতালও থাকছে নোংরা, দুর্গন্ধময়।

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর অভাব সর্বাধিক। তাই উপচে পড়া রোগীর এ হাসপাতাল সবসময়ই থাকে অপরিচ্ছন্ন এবং দুর্গন্ধময়।

রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের মেঝে, বাথরুম (গোসলখানা) পরিষ্কার করা হলেও মাসে একবারও পরিষ্কার করা হয় না বেসিন, টয়লেট এবং ময়লার বিন। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগীর সুস্থতা কতটা ত্বরান্বিত হবে- এই প্রশ্ন রোগী এবং স্বজনদের।

হাসপতালটিতে আছে ডাক্তারেরও সংকট। ফলে অস্ত্রোপচার করতে জমে যায় দীর্ঘ লাইন। আর তাতে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকা রোগীদের কেউ কেউ আর সুস্থ হয়ে ফেরেন না শেষ পর্যন্ত।

শজিমেকে ড্রামাটোলজি অ্যান্ড ভেনোরলজী, নেফ্রোলজী, নিউরোলজী, ইউরোলজী, পেডিটিক সার্জারি, নিউরো সার্জারী পদে ইনডোর মেডিকেল অফিসার নেই। ফলে ভর্তি রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বিভাগগুলোতে সহকারী রেজিস্ট্রারও নেই। ড্রামাটোলজি বিভাগে একজন সহকারী রেজিস্ট্রার আছেন। কিন্তু তিনি বহিঃবিভাগে রোগী দেখেন, ভর্তি রোগীদের দেখেন না।

ডাক্তারের এই সংকটে দীর্ঘায়িত হচ্ছে রোগীদের অপারেশন। এমনকি জটিল অপারেশনেও সিরিয়াল পেতে সময় লাগছে ১ থেকে ২ মাস পর্যন্ত।

অপারেশন হতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগছে নিউরোসার্জারি বিভাগে।

সম্প্রতি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে ১ মাস ১০ দিন হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগে অপারেশনের অপেক্ষায় থাকেন জিন্নাহ ফকির। তিনি বলেন, “সিরিয়াল পাইতে পাইতে ছেলের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। একসময় অজ্ঞান হয়্যা গেল। তবু অপারেশনের সিরিয়াল পাইনি। যখন সিরিয়াল পানু তখন আর অপারেশন করে জ্ঞান ফেরেনি। পরে ঐ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে পাঠালো ছেলেডাক। সেটি যাইয়ে অপারেশনের পরে ধরা পড়লো ক্যান্সার। তারপর তিন মাস পর ছেলেডা মরে গেল। যদি সময়মতো অপারেশন হলোনি, তাহলে ছেলেটার ক্যান্সার হলো না হিনি।”

শজিমেক উপাধ্যক্ষ নিউরো সার্জারি বিভাগের ডা. সুশান্ত কুমার বলেন, “একসিডেন্ট, সংঘর্ষ, কাটাছেঁড়া, ব্রেনের সমস্যা- সব মিলিয়ে সার্জারি বিভাগে খুব চাপ। সপ্তাহে একদিন অপারেশন হওয়ার কারণে সিরিয়াল দীর্ঘ হয়ে যায়।”

শুধু সার্জারি বিভাগ নয়, হাসপাতালের সব বিভাগেই রোগীর চাপ বাড়ছে।

চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ছাইদুর রহমান বলেন, শুধু বগুড়া জেলার মানুষ নয়, উত্তরবঙ্গের ৪-৫টা জেলার রোগী শজিমেকে এসে চিকিৎসা নেয়। সেই তুলনায় শজিমেকে ডাক্তারের সংখ্যা কম। শিগগিরই ডাক্তারের সংখ্যা না বাড়ালে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা যাবে না। হাসপাতালের বেডও বাড়াতে হবে।”

শজিমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটিতে ডাক্তারের পদ ২২৩ টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১৯০ জন। শূন্য পদ ৩৩ টি। নার্সের পদ ৫২১ টি। কর্মরত আছেন ৫১৮ জন, শূন্য ৩ টি পদ। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার পদ ৮টি। কর্মরত আছেন ৩ জন। শূন্য ৫টি পদ।

হাসপাতালটিতে জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু গ্যাস্ট্রো: অ্যান্ড নিউটেশন) ১ টি, চক্ষু বিভাগে ১টি, ক্যাজুয়েলিটি বিভাগে ১ টি, অর্থো ও ট্রমাটোলজি ১টি, রেজিস্ট্রার শিশু-২ বিভাগে ২ টি, রেজিস্ট্রার ডেন্টাল ১টি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন ১টি, নাক কান গলা বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ৩টি, কার্ডিওলজী বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, রেডিও থেরাপি বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, চেস্ট ডিজিজেস বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, নিউরো সার্জারী বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, ইউরোলজী বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১ টি, ফিজি মেডি বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, পাস্টিক বার্ন বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, গ্যাস্ট্রো অ্যান্ড নিউটেশন বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, পেডি: নেফ্রো: বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ১টি, শিশু বিভাগে ২টি, সহকারী সার্জন/মেডিকেল অফিসার (নাক, কান, গলা) বিভাগে ৪টি, ডায়ালাইসিস মেডিকেল অফিসার ২টি, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ১টি, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ২টি, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ২টি, রেডিওলজিস্ট ১টি, সাইকোলজিস্ট ১টি, বায়োকেমিস্ট্রি ১টি, ডায়াটেশিয়ান ১টি, সেবা তত্ত্বাবধায়ক ১টি, চীফ থেরাপিস্ট ১টি, ফার্মাসিস্ট গ্রাজুয়েট ১ টি, অ্যাসিসটেন্ট চীফ পরিসংখ্যান অফিসার ১ টি পদ শূন্য পড়ে আছে।

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর পদ আছে ১৭২ টি। কর্মরত আছেন ১১৭ জন। শূন্য পদ ৫৫ টি।

চতুর্থ শ্রেণিতে আছে ৪১৫ টি পদ। কর্মরত আছেন ২৯৭ জন। শূন্য পদ ১১৮টি।

মুখে টিউমার নিয়ে নাক, কান, গলা বিভাগে ২০ দিন ভর্তি ছিলেন স্বপ্না বেগম। তারপর উন্নত চিকিৎসা নিতে ঢাকায় যান তিনি। স্বপ্না বেগম বলেন, “হাসপাতালে যদ্দিন থাকছি একদিনও টয়লেট পরিষ্কার করতে দেকিনি। আর ময়লার বিনগুলোর গন্দে বাথরুমত যাওয়াই যায় না। থালাবাটি ধোবার জন্নি নাকোত কাপড় বান্দে বাথরুমত যায় সগলি। আর দুই-একদিন পরই বাথরুমোত পানি আটকে থাকে পায়ের গিরা পর্যুন্ত।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শজিমেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মহসিন বলেন, “হাসপাতালের শূন্যপদগুলো পূরণের জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কিছু পদ পূরণ হয়েছে। বাকীগুলোও শিগগিরই পূরণ হওয়ার কথা আছে। ডাক্তারের পাশাপাশি হাসপাতালের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে যেন প্রত্যেক বিভাগে অপারেশনের সিডিউল বাড়ানো যায়। সে লক্ষ্যে হাসপাতাল এক্সটেনশনের প্রক্রিয়া চলছে।”

এনসিএন/এসকে

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print