অক্টোবর ১৫, ২০২৫ ৯:১৩ এএম

২৩ বছরের কারাভোগ শেষে নতুন জীবনের পথে ইসমাইল; নব-দম্পতির জন্য ডিসির আবেগঘন অনুভূতি

Oplus_16908288
Oplus_16908288

দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগ শেষে মুক্ত হয়েছেন ইসমাইল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। মুক্ত হয়েই ডিসির উপহার নিয়ে শুরু করেন বাঁচার সংগ্রাম। করেছেন বিয়ে। নব বঁধুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক আব্দুল আউয়াল এঁর সাথে দেখা করতে। এখন ইসমাইল হোসেন তাঁর জীবন সঙ্গিনীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন নতুন জীবনের।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) মুঠোফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল।

ইসমাইল হোসেন নওগাঁর সাপাহার উপজেলার কলমুডাঙ্গা গ্রামের মৃত-সাইদুর রহমানের ছেলে।

ইসমাইলের বাবা ছিলেন একজন গ্রাম পুলিশ। গরীব পরিবারের সন্তান ইসমাইল হোসেন কলমুডাঙ্গা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন নৈশ্যপ্রহরী ছিলেন। নিজের শরিকানদের সঙ্গে সামান্য জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো ইসমাইলের পরিবারের। সেই দ্বন্দ্বের জের ধরে শরিকানরা ইসমাইলের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করে। সেই মামলার আসামী হিসেবে ইসমাইলকে আটক করে ২০০০সালে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করে পুলিশ।

ইসমাইলের গরীব পরিবার অর্থের অভাবে তার জন্য একজন উকিল নিযুক্ত করতে পারেনি। ফলে ২০০৩সালে আদালত ইসমাইলের যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। এরপর থেকে জেলখানার চারদেয়ালের মাঝে বন্দি থাকার ২৩বছর ৩মাস ৭দিন পর গত বছরের ডিসেম্বরের ১৫তারিখে মুক্ত হয় ইসমাইল। এই দীর্ঘ সময়ে ইসমাইল তার বাবাসহ পরিবারের অনেককেই হারিয়ে ফেললেও নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের জেলখানা পরিদর্শন পাল্টে দেয় ইসমাইলের জীবনের সবকিছু। জেলখানার মাঝে ইসমাইলকে দেওয়া জেলা প্রশাসকের প্রতিশ্রুতি একজন সব হারানো কয়েদী ইসমাইলকে নতুন করে বেঁচে থাকার রঙ্গিন স্বপ্ন দেখার সাহস যোগায়। মুক্তির দিনে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে পুর্নবাসনের উপহার হিসেবে পাওয়া একটি ভ্যান পাল্টে দেয় ইসমাইলের জীবনকে। আজ ইসমাইল নতুন সঙ্গিকে সাথে নিয়ে তাদের রঙ্গিন জীবনকে সাজানো আর গোছানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমন কাজে সব হারানো অসহায় ইসমাইল সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।

সম্প্রতি সেই ইসমাইলকে নিয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের আবেগঘন অনুভূতির কথা লিখেন। সেই লেখাটি হচ্ছে-জীবন বড় বিচিত্র। ছবিতে যাদের সঙ্গে কথা বলছি, ছবি তুলছি তারা ইসমাইল দম্পতি। এই সেই ইসমাইল যার ২৬বছর জেল হয়েছিল। নওগাঁতে দায়িত্ব গ্রহণের পর জেলখানা পরিদর্শনের প্রথম দিন সাহস করে সে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তার পুনর্বাসনের আবদার করে। সেদিন কথা দিয়েছিলাম তার মুক্ত হবার দিন পর্যন্ত আমি যদি নওগাঁতে অবস্থান করি তবে অবশ্যই তার আবদার বিবেচনা করব। কাঙ্খিত মুক্তির দিনে ইসমাইল আর কোথাও যায়নি, যাবেই বা কোথায়? সেদিন সে সোজা চলে এসেছিল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তার আবদার বৃথা যায়নি। তার সকল কিছু পর্যালোচনা করে নতুন জীবনে ফিরে আনার চেষ্টা করে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সফল হয়েছে কিনা বলা মুশকিল। তবে ইসমাইল নতুন জীবনে ফিরেছে। বিয়ে করেছে ইসমাইল। দাপ্তরিক চাপে, তার বিয়েতে যেতে পারিনি। তাই সে সস্ত্রীক জেলা প্রশাসনকে তার নববধূকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আজ এসেছিল। তাকে এবং নববধূকে যখন মিষ্টিমুখ করাচ্ছিলাম, যখন তাকে ফুল দিয়ে বরণ করছিলাম তখন দেখলাম তার চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার এমন ভাষা যা সে প্রকাশ করতে পারল না। হয়তো আরো কিছু দাবি ছিল আমার কাছে কিন্তু কৃতজ্ঞতার ভাষায় তার মনের কথা অব্যক্তই থেকে গেল। কিন্তু আমি বুঝে নিয়েছি তার মনের কথা, সে আমার আজন্ম সাথী হয়ে থাকতে চায়। তার স্ত্রীকে শুধু বললাম আশীর্বাদ, দোয়া, ভালোবাসা এগুলো দেখানোর জিনিস না। যে ইসমাইল তার যৌবনের পুরোটা সময় চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি রেখেছিল সেই ইসমাইল তার বাকি জীবন তার প্রিয় সঙ্গীনীর সঙ্গে হেসে খেলে আনন্দে কাটাক এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। ইসমাইলকে একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলতে বলেছি যাতে ভবিষ্যতে বিপদের সময় আর কারো কাছে তার মুখাপেক্ষী হতে না হয়। আমাদের ইসমাইলের জন্য সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী। ইসমাইলের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আমাদের সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ দারুন ভূমিকা রেখেছে। ইসমাইল আমার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা পোষণ করেছে, তার চোখে মুখে যে অস্ফুট উচ্চারণ তার ভাগীদার আমার প্রিয় সহকর্মীগণ।

ভালো থাকুক ইসমাইল, ভালো থাকুক আমাদের প্রিয় মানুষগুলো।

মুঠোফোনে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল সম্পর্কে ইসমাইল হোসেন তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে জানান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল স্যার ভালো মনের একজন মানবিক মানুষ। মহান আল্লাহ হায়াত অবধি ডিসি স্যারকে সুস্থ্য রাখুন। ডিসি স্যারের দেখানো স্বপ্নের কারণে তিনি জেলখানার অন্ধকার জীবনের দীর্ঘ সময় পর মুক্ত হয়ে একটি সুস্থ্য ও সুন্দর জীবনের আশায় আলোর পথে হাটা শুরু করেছেন। ডিসি স্যার তাকে সাপাহার উপজেলার নিশ্চিন্তপুর মোড়ে ছয়শতক জমি দিয়েছেন। সামর্থ না থাকার কারণে সেখানে এখনো ঘর নির্মাণ করতে পারেননি ইসমাইল।

বর্তমানে ইসমাইল সাপাহার উপজেলার নিশ্চিন্তপুর ভেলাকুড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি বাড়িতে নতুন বউকে নিয়ে বসবাস করছেন। এমন কর্মকর্তা যদি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে থাকতো তাহলে তার মতো সব হারানো অন্ধকার পৃথিবীর মানুষরা নতুন জীবনে ফিরে এসে আলোর জগতের বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ পেতো। পথচলার আগামীর জীবনকে আরো একটু সাজিয়ে নিতে ইসমাইল জেলা প্রশাসকসহ সমাজের সকল মানুষদের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।

ডিসি আব্দুল আউয়াল বলেন, ইসমাইল তার স্ত্রীকে নিয়ে গত বুধবার দেখা করতে এসেছিলেন। তাদের চেখে মুখে ছিল নতুন করে বাঁচার আনন্দ। আমার খুব ভালো লেগেছে। তাদের জন্য কতোটুকু করতে পেরেছি তা জানি না। তবে তাদের জন্য সবসময় দোয়া থাকবে।

তিনি আরও বলেন, জেল থেকে বের হওয়ার দিন ইসমাইলকে বিভিন্ন রকমের সবজিসহ একটি ভ্যান উপহার দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া তাকে থাকার জন্য কিছু জমি দেওয়া হয়েছে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print