মে ১৭, ২০২৪ ৪:৩৮ পিএম

দুদক গতকাল ৫৯ মামলার অভিযোগপত্র অনুমোদনের কথা জানিয়ে বলেছে, ৫৮টিতেই অভিযুক্ত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই।

৫৮ মামলায় আসামী বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা শেখ আবদুল হাই

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই। ছবি: ইন্টারনেট
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই। ছবি: ইন্টারনেট

রাষ্ট্রীয়মালিকানাধীন ব্যাংক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা ছিলেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই ওরফে বাচ্চু। তারপরও তাকে সম্মানের সহিত পদত্যাগ করার সুযোগ দিয়েছিলো সরকার।

পরের আট বছর আত্মসাৎ করা অর্থে বাড়ি ও জাহাজ কিনে আরাম-আয়েশেই জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি। এ নিয়ে বারবার আদালতের তিরস্কারের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংসদ সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের বিরূপ সমালোচনার পর অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে আসামি হলেন তিনি।

আবদুল হাইসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে দুদক অভিযোগপত্র দিচ্ছে ৫৯টি। এর মধ্যে ৫৮টিতেই শেখ আবদুল হাই আসামি। তবে তাঁর দুই মেয়াদের পর্ষদে যাঁরা পরিচালক ছিলেন, তাঁদের কাউকেই আসামি করেনি দুদক। অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রস্তাব গতকাল সোমবার অনুমোদন করেছে দুদক। এখন এগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হবে। দুদক কার্যালয়ে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

মামলায় আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করায় দুদকের ওপর কোনো চাপ ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কোনো চাপের মুখে পড়ে কাজ করে না। এ ক্ষেত্রেও কোনো চাপ ছিল না।’

দুই দফায় শেখ আবদুল হাই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত। এ সময়ে ব্যাংকটি থেকে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে।

অনুসন্ধানের পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় প্রথমে ৫৬টি মামলা করা হয়। পরে মামলা হয় আরও ৩টি। এসব মামলার ১টিতেও এত দিন আসামি ছিলেন না শেখ আবদুল হাই। নিবিড় তদন্তের পর এবার ৫৮টিতেই ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে শেখ আবদুল হাইয়ের সম্পৃক্ততা পায় দুদক। দুদকের পাঁচজন কর্মকর্তা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সম্প্রতি প্রতিবেদন দিয়েছেন।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যখন মামলা করা হয়, তখন দুদক চেয়ারম্যান ছিলেন মো. বদিউজ্জামান। তাঁর সময়ে মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তারপর ২০১৬ সালে দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে ইকবাল মাহমুদ পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করলেও তদন্ত শেষ হয়নি তখনো। বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ২০২১ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর এখন বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হয়।

আবদুল হাই ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া দেয়। বর্তমান সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত।

সে হিসেবে মামলার তদন্ত করে অভিযোগপত্র তৈরি করতে দুদকের আট বছর লেগে যায়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিএজি) এবং বেসিক ব্যাংকেরই নানা প্রতিবেদনে এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইসহ অনেকের জড়িত থাকার প্রমাণ আগেই উঠে আসে।

আবদুল হাই ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া দেয়। বর্তমান সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত।

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় শেখ আবদুল হাই ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় দেড় বিঘার একটি বাড়ি কিনেছিলেন। একক কর্তৃত্বে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে সেসব ঋণের একটি বড় অংশ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন তিনি। সেই টাকা দিয়েই কেনা হয়েছে এই বাড়ি।

শেখ আবদুল হাই ২০০৯ সালে যোগ দেওয়ার সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ শতাংশ আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশ। কেলেঙ্কারির পর এখন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকাও দেয় সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য শেখ আবদুল হাইকে সরাসরি দায়ী করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ও সংসদের বাইরে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎকে ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার জন্য তিনি হতাশাও প্রকাশ করতেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার আগে ফজলে নূর তাপস যখন সংসদ সদস্য ছিলেন, তখন ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর আদালতে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এত বড় কেলেঙ্কারির পর তাঁকে গ্রেপ্তার না করা দুদকের ব্যর্থতা। এ ব্যাপারে দুদকের জবাবদিহি দরকার।’ এ ব্যর্থতার জন্য দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগও চেয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে ধরা পড়ে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শেখ আবদুল হাই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই দেওয়া হয় নিয়ম ভেঙে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করে, আর পর্ষদ ভেঙে দিতে ওই বছরের ২৯ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। এর পর ৪ জুলাই অর্থাৎ স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন শেখ আবদুল হাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবদুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

 

সূত্র: প্রথম আলো

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print