ডিসেম্বর ১, ২০২৫ ৪:৪৪ অপরাহ্ণ

অপেক্ষায় থাকেন দালাল সিন্ডিকেটরা

যখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বসেন, তখন বন্ধ হয়ে যায় ল্যাবের টেস্ট 

ছোট বোনকে নিয়ে গত সোমবার হাসপাতালের ল্যাবে রিপোর্ট করার জন্য এসেছিলেন এক সেবাগ্রহীতা। বেলা ১২টা বাজার অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে আর রিপোর্ট হবেনা বলে। তার বোন নওগাঁর মান্দা উপজেলা থেকে এসেছে, আবার আসা সম্ভব হবেনা, একটু সাক্রিফাইস করে রিপোর্টটা করে দেওয়ার অনুরোধ করলে বাহিরে থেকে ৫০০টাকার জায়গায় তারা ৪০০টাকায় করে দিতে চেয়েছেন। এভাবেই বলছিলেন শহরের কাজির মোড়ের আরিফা নামের এক সেবাগ্রহীতা। তার ছোট বোন হাবিবাকে নিয়ে আবারও সেবা নিতে এসেছেন এই হাসপাতালের ল্যাবে। তিনি ক্ষোভ নিয়েই বলেন, হাসপাতালে যেহেতু চিকিৎসা নিতে এসেছি আমরা বাহিরে কেন পরীক্ষা করবো। তাই বাধ্য হয়ে আজ আবার আসা। তাও আমরা এখান থেকে করে নিব। তিনি বলেন, আমি শহরে থাকি, তাই আবার আসতে পেরেছি, কিন্তু যারা গ্রাম থেকে আসে তাদের কি বারবার আসা সম্ভব প্রশ্নের সুরে বলেন তিনি।

শহরের চকপ্রসাদ চারমাথা এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন শারমিন নামের আরেক সেবাগ্রহীতা। তিনি বলেন, যখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বসেন, তখন বন্ধ করে দেয় এই ল্যাবের কার্যক্রম, রিপোর্ট করতে চায়না। তাহলে আমরা কোথায় কখন রিপোর্ট করবো আক্ষেপ ও প্রশ্নের সুরের বলেন তিনিও।

পাশে থাকা অনেক সেবাগ্রহীতা বলেন, এখানে যতো রোগী হয়, ল্যাবের কার্যক্রম চারটা পর্যন্ত হওয়া উচিৎ। আবার অনেকে বলেন দুটো পর্যন্ত অন্তত তাদের প্যাথলজি খুলে রোগীদের টেস্ট করানো উচিৎ। কারণ ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়াল ধরতে হয়, ডাক্তার দেখিয়ে রিপোর্টের জন্য এখানে আসবো কখন। তাই তারা অভিযোগের সুরে ক্ষোভ নিয়ে জানালেন, ডাক্তার আসার পরপরই যদি ল্যাব বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের মতো গরীবরা টেস্ট করাবে কোথায়? আর ল্যাবে যারা থাকে, তাদের দায়িত্ব কি ১২টা পর্যন্ত?   বলছি নওগাঁ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর আধুনিক হাসাপাতালের কথা। এই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বসেন ১২টায়। আর এই হাসপাতালের প্যাথলজির ল্যাবে দুপুর ১২টার আগ পর্যন্ত নেওয়া হয় স্যাম্পল, করা হয় পরীক্ষা। এরপর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি কোনো পরীক্ষা দেয়, তাহলে যেতে হয় বাহিরের কোনো ডায়াগনস্টিকে বা ক্লিনিক হাসপাতালে। ফলে সাধারণ রোগীদের পকেট কাটা যাচ্ছে। মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর সরেজমিনে ও একাধিক ভূক্তভোগীদের সাথে কথা বলে বিষয়টি জানা যায়।

এদিকে সমস্যার কারণে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার কুজাইল গ্রাম থেকে ৩৫ সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট লিপি বসাককে সাথে করে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছিলেন তার মা দীপিকা ও বোন শান্ত সরকার। করা হয়েছিল ভর্তি। কর্মরত ডাক্তার ইউরিন, রক্তের গ্রুপ ও আল্ট্রাসহ কিছু টেস্ট দিলে করতে যায় হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবে। তখন ঘড়ির কাটা পৌনে ১২টার ঘরে। প্যাথলজিতে দায়িত্বরত একজন সরাসরি বলে দেয় এখন পরীক্ষা হবেনা, বাহির থেকে করে নিয়ে আসেন। বিষয়টি হাসপাতালের আউটডোরের ইনচার্জকে জানালে তিনি সহযোগীতা করে সকল টেস্ট করার ব্যবস্থা করে দেন। করানো হয় আল্ট্রাসহ অন্যান্য টেস্ট। কিন্তু পরবর্তীতে সাড়ে ১২টার দিকে ইউরিন আর নিবেনা বলে আবারও সাফ জানিয়ে দিলেন সেখানে দায়িত্বরতরা। আবারও বাহির থেকে করে নিয়ে আসতে বললেন। কারণ হিসেবে জানালেন ইউরিন দেওয়ার জন্য বাথরুম এক মাস থেকে অচল। বিষয়টি আবারও ওই ইনচার্জকে জানালে প্যাথলজির রুম থেকে তরিকুল নামের একজন বের হয়ে এসে ইউরিন নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এরমধ্যে জানতে চাওয়া হয় কারণ। একসময় এই প্রতিবেদকের কাছে এগিয়ে আসেন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা অনেক ভূক্তভোগী। তারা ক্ষোভের সাথে একাধিক অভিযোগ তুলে ধরলেন।

১১টি উপজেলা নিয়ে গঠিত প্রায় ৩০ লাখ জেলাবাসীর ভরসার একমাত্র আস্থা এ হাসপাতাল। শষ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরের এ জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। তাদের অধিকাংশই সহজ সরল ও হতদরিদ্র। তাই তারা বঞ্চিত অনেক কাঙ্খিত সেবা থেকে।

জানা যায়, ভালো চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটিকে প্রথমে ১০০ শয্যা এরপর ২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতালের কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়। এখানে নামমাত্র সরকারি ফি দিয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের ভালো চিকিৎসা সেবা নিতে চায় নি¤œ ও মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। সেই জন্য দিন দিন বাড়ছে রোগীর চাপ। ফলে প্রতিদিন আউটডোরে অন্তত দেড় হাজার মানুষ চিকিৎসা নেয়। এখানে ভালো চিকিৎসা নেওয়ার জন্য গড়ে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকেন তিনশ জন।

হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়ার পর জেলাবাসীর স্বপ্ন ছিল অন্তত চিকিৎসা সেবার মান বাড়ার পাশাপাশি সেবা পেয়ে উপকৃত হবে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। এখনও চলছে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায়। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা ও দালাল সিন্ডিকেটের কারণে সুনামক্ষুন্ন হচ্ছে হাসপাতালের। অপরদিকে সংশ্লিষ্টদের অজুহাত ১০০ শয্যার লজিস্টিক দিয়েই চলছে ২৫০ শয্যার কার্যক্রম, তাই এতো রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। যার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে।

১২টার পর ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ থাকে কিনা বিষয়টি জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: জাহিদ নজরুল চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, ১২টা পর্যন্ত স্যাম্পল নেওয়া হয়, তারপর কাজ করে। একজন সেবাগ্রহীতাকে বলা হয়েছে বাহিরে ৫শ টাকার জায়গায় ৪শটাকা দিয়ে করানো যাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অফিসের কেউ এরকম কথা বলতেই পারেনা, তিনি সর্ব্বোচ্চ বলতে পারেন আজ হবেনা। তিনি আরও বলেন, আমি অফিসে ছিলাম, আমাকে এসে জানালে ভালো হতো। সাধারণ রোগী কি করবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এরকম ভোগান্তি হতেই পারে সেটা আমি অস্বীকার করছিনা। যে এসব কথা বলেছে তার নাম কি। নাম বললে আমার পক্ষে ভালো হতো। তাদেরকে বলা আছে, তোমরা যতোক্ষণ পর্যন্ত রিপোর্ট করতে পারবে ততোক্ষণ পর্যন্ত কাজ করো, ১২টা বলে কিছু নেই, কিন্তু লোকবল সীমিত। আর তাদের গরজ কম। ভোগান্তিসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নলেজে আছে, আসলে সমস্যা তো সব জায়গায়। তিনি বললেন, প্যাথলজির দুই একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই সবকিছু কন্ট্রোলে আসবে। এছাড়া বিষয়টি তিনি গুরুত্বসহকারে দেখবেন বলেও জানান।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print