আওয়ামীলীগের অধীনে গত বছরের ২৯মে অনুষ্ঠিত হয় ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আ’লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মোটরসাইকেল প্রতিক নিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছেন মো: গোলাম রাব্বানী। মাত্র ২৭২৪টি ভোট পেয়ে জামানত হারান তিনি। সেই গোলাম রাব্বানী এখন ভিপি নুরুল হক নুরের দল গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) নওগাঁ জেলা শাখার আহ্বায়ক।
গত ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৬ মাসের জন্য অনুমোদন দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করেছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন। এরপর শুরু হয় সমালোচনা আলোচনা। ক্ষোভে ফেটে পড়েন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। বর্তমানে নওগাঁ শহরের বিভিন্ন দেয়ালে গণঅধিকার পরিষদের প্রতিক ট্রাক ও ভিপি নুরুল হক নুরের ছবিসহ নতুন বছরের রঙ্গিন শুভেচ্ছা পোস্টার লাগিয়েছেন গোলাম রাব্বানী।
নওগাঁ জেলা গণঅধিকার পরিষদ ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের একাধিক নেতার অভিযোগ গোলাম রাব্বানী নওগাঁর রাণীনগর উপজেলা আ’লীগের সদস্য ছিলেন। গত বছরের ৫আগস্টে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পর আ’লীগ সরকারের বিদায়ের পর নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই মূলত অর্থের বিনিময়ে নিজের খোলস পাল্টিয়ে গোলাম রাব্বানী গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হয়েছেন। গণঅধিকার পরিষদের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের যোগসাজশে বিতর্কিত ওই ব্যক্তিকে আহ্বায়ক করা হয়েছে বলে একাধিক নেতার অভিযোগ। যার কারণে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, কেউবা অভিমান করে দূরে আছেন। আবার কেউবা সহ্য করে আছেন নীরবে। আর গোলাম রাব্বানীর দাবি তিনি এলাকায় ব্যবসা করার সুবিধার্থে নিজেকে আওয়ামীলীগের সদস্য পরিচয় দিয়েছেন।
সূত্রে জানা গেছে, গোলাম রাব্বানীর বাবা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা (তালিকাভুক্ত) আলহাজ্ব আজিজার রহমান উপজেলা আওয়ামীলীগের ৭নং একডালা ইউনিয়ন শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন। এই রাজনীতি করতে গিয়ে ৫বার নির্বাচিত জনপ্রিয় একডালা ইউপি চেয়ারম্যান রাব্বানীর বড় চাচা বীরমুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনকে ২০০৪ সালে দিনে-দুপুরে গলা কেটে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ২০০৩সালে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ফ্রান্স দেশে চলে যান। এরপর ২০১৮সালে দেশে ফেরার পর থেকে আওয়ামীলীগের সাথে সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। নিজেকে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে প্রচার করে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করতে উপজেলা আ’লীগের নেতাকর্মীদের সাথে মিশে থাকেন। কখনও পরিচয় দেন সদস্য, কখনও বা সমর্থক। আর এভাবেই চলে তার রাজনীতি।
নওগাঁ জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সিনিয়র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, আমরা শুরু থেকেই গোলাম রাব্বানীর বিপক্ষে ছিলাম। এমনকি আমাদের জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি প্রথম থেকেই রাব্বানীর ঘোর বিরোধীতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কোন এক অদৃশ্য কারণে তাকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। হয়তোবা লিঁয়াজো হয়েছে। একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আর এই কারণে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হচ্ছে। আমরা আওয়ামীলীগকে নাকি পূণর্বাসন করছি।
একইভাবে বিরোধীতা করা হয়েছে জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন জেলা ছাত্র, যুব ও গণঅধিকার পরিষদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা। তারা আক্ষেপের সাথে মুঠোফোনে জানালেন, আওয়ামীলীগের সময় অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। অথচ গোলাম রাব্বানী ছিল বহাল তবিয়তে। এমনকি শেখ হাসিনা সরকার পতনের কয়েক মাস আগেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেছে। নওগাঁ জেলার প্রায় সবগুলো ইউনিট থেকে গোলাম রাব্বানীর বিরোধিতা করা হয়েছিল। কিন্তু পেরে উঠতে পারিনি। হুট করে এসে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হয়েছেন তিনি। অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে তাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। টাকার বিনিময়েই সে আহ্বায়ক হয়েছে।
তবে তাদের সকলের দাবি, নওগাঁ জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আলফে সানি ও গণঅধিকার পরিষদের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন কবিরের যোগসাজশে গোলাম রাব্বানীকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে সুমন কবির ভাই। তার যোগসাজশেই গোলাম রাব্বানীকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কাজেই সকল দায় তার। কেন্দ্র সুমন কবির ভাইয়ের উপর আস্থা রেখে কমিটি অনুমোদন করেছে। এক্ষেত্রে সুমন কবির তার পদের অপব্যবহার করেছেন। তাই আমরা কেন্দ্রের প্রতি জোর দাবি জানাই এমন বিতর্কিত আহ্বায়ক সাথে রাজনীতি করা সম্ভব না। আমাদের বিশ্বাস কেন্দ্র বিষয়টি সুদৃষ্টি দিয়ে দেখবেন।
মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য নওগাঁ জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আলফে সানির মুঠোফোনে অনেকবার ফোন করেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি। অবশ্য কয়েক দিন আগে তিনি মুঠোফোনে বলেন, অথনৈতিক লেনেদের বিষয়টি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। গোলাম রাব্বানীর আগে থেকেই কেন্দ্রের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তৃনমূলের সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলনা। পরে সম্পর্কের উন্নতি হলে সকলের মতামতের ভিত্তিতে তাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। আর সে আওয়ামীলীগের কোন পদে ছিলনা। তবে কারো সাথে সম্পর্ক থাকতেই পারে বা সমর্থক হতেই পারে বলে সাফাই গাইলেন তিনি।
মঙ্গলবার জানতে চাইলে একইভাবে গোলাম রাব্বানীর পক্ষে সাফাই গেয়ে জবাব দিলেন গণঅধিকার পরিষদের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন কবির। তিনি মুঠোফোনে বলেন, গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। কারণ সে আওয়ামীলীগের সদস্য ছিল এমন কোন প্রমান নেই। তিনি গর্বের সহিত বলেন, আমিও ২০১৮ সালে ছাত্রলীগ করেছি, এমনকি কেন্দ্রের অনেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছে। আমি আওয়ামীলীগ থেকে এসেছি। ২০২১ সালের পর আমরা এই দলের সাথে জড়িত। এছাড়া তাকে প্রশ্ন করাই এই প্রতিবেদকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। টাকা দিয়ে কেনা যায় এমন বাজে মন্তব্যও করেন তিনি। আবার গোলাম রাব্বানী নির্বাচন করার পর কিভাবে স্থান পায় এমন বিষয়ে জানতে চাইলে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয় বলে এড়িয়ে যান তিনি।
গোলাম রাব্বানীর কাছে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান ২০২১সাল থেকে তিনি গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কিন্তু তখন গণঅধিকার পরিষদের নিবন্ধন না থাকার কারণে প্রকাশ্যে কিছু করতে পারেননি। উপজেলা আ’লীগের সদস্য ছিলেন না মর্মে তিনি বিভিন্ন সময় তৎকালীন স্থানীয় এমপিদের রোষানল থেকে বাঁচতেই মূলত আ’লীগের তকমা লাগিয়ে চলেছেন বলে জানান গোলাম রাব্বানী। আর পোস্টারগুলো ভুয়া, এডিট করা। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছি, সেটা ভিপি নুর জানেন।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীর সাথে ছবি থাকতেই পারে। এছাড়া সেসময় ব্যবসা করার জন্য আমাকে আওয়ামীলীগের সাথে মিশে থাকতে হয়েছে। আর কয়েকজনকে টাকা না দেওয়ার কারণে তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তবে টাকা দিয়ে পদ নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা বলে মন্তব্য করেন তিনি।
