অক্টোবর ১৫, ২০২৫ ৫:৫৮ এএম

ঘুষ না দিতে পারায় মেলেনি ভাতা কার্ড, পা হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন আইসক্রিম বিক্রেতা রফিকুলের

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জীবনের চাকা থেমে গেছে রফিকুল ইসলামের। এক সময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করে হাসিমুখে সংসার চালাতেন তিনি। কিন্তু তিন বছর আগে হঠাৎই সেই হাসি মুছে যায় — রক্ত জমাট বাঁধে তাঁর পায়ের রগে, শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা আর যন্ত্রণার দিনরাত। শেষমেশ দেড় বছর আগে সেই পা কেটে ফেলতে হয়। আর সেই সঙ্গে কেটে যায় সংসারের হাসি, আশা আর স্বপ্নও।

রফিকুল ইসলাম (৫০) বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার বুড়ইল ইউনিয়নের পৌতা গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে। এখন তিনি ভাঙা বাঁশের বেড়ার এক জরাজীর্ণ কুটিরে, সন্তানহীন স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে নিয়ে অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন।

একসময় ভ্যানে ফেরি করে আইসক্রিম ও ভাঙারি বিক্রি করতেন রফিকুল। সামান্য আয়েই কোনোমতে সংসার চলত। কিন্তু এখন স্ত্রী শাহনাজের হাত-পাতা আর মানুষের দয়া ছাড়া ভাত জোটে না ঘরে।

চোখে জল নিয়ে রফিকুল বলেন, “খাওয়ার কষ্ট তো আছেই, কিন্তু রাতে যখন ব্যথা বাড়ে, মনে হয় মরে যাই। ওষুধ কিনতে পারি না, ক্ষতস্থানের পচা গন্ধে ঘুম আসে না। কখনও কখনও মনে হয় — আমি বেঁচে আছি কেন?”

স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, “আমার স্বামী পা হারানোর পর আমরা সবকিছু হারিয়েছি। সমাজসেবা অফিসে গিয়েছিলাম প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য, তারা পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিল। টাকা দিতে পারিনি বলে কার্ড দেয়নি। এখন মানুষের দয়ার ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছি।”

চোখেমুখে ক্লান্তির রেখা নিয়ে তিনি আরও বলেন, “প্রতিদিন সকালে ভাবি, আজ কীভাবে ওর জন্য ওষুধ আনব। একবেলা খেতে পারি না, তবু বাঁচতে হয়।”

প্রতিবেশী আলম হোসেন জানান, “আমরা যতটা পারি সাহায্য করি, কিন্তু তাতে কি চলে? রফিকুল ভাই যদি একটা কৃত্রিম পা বা প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড পেতেন, তাহলে হয়তো আবার বাঁচার ইচ্ছাটা ফিরে পেতেন।”

তবে প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলামের করা অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে ১নং বুড়ইল ইউনিয়নের সমাজসেবা কর্মকর্তা আলিনুর ইসলাম বলেন, আমার ওপর যে অভিযোগটি আনা হয়েছে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াটা ও ভিত্তিহীন। আমি তার থেকে কোন টাকা পয়সা চাইনি।

এ বিষয়ে নন্দীগ্রাম উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমি রফিকুল ইসলামের বিষয়ে অবগত নই। যদি কেউ অবৈধভাবে টাকা চেয়ে থাকে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভাতা কার্ডের জন্য সহযোগিতা করা হবে।”

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) নবাগত ইউএনও মোঃ আরিফুল ইসলামের সাথে সাংবাদিকদের মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রফিকুলের জীবন কাহিনী তুলে ধরেন সাংবাদিকরা। রফিকুলের এমন জীবন কাহিনী শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন নবাগত ইউএনও আরিফুল ইসলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সমাজসেবা কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে গিয়ে তার খোঁজ নেওয়ার সহ রফিকুলকে একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। এছাড়াও ইউএনও রফিকুলকে সরকারিভাবে সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

আজও এক টুকরো আশার আলো খুঁজে ফেরেন রফিকুল। সরকারি সহায়তা আর মানবিক মানুষের সহানুভূতিই হয়তো তাঁর জীবনে নতুন ভোর এনে দিতে পারে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print