ডিসেম্বর ১, ২০২৫ ১২:২৩ অপরাহ্ণ

প্রশাসনের অভিযানেও থামছেনা তাদের দৌরাত্ম

বাঁধ কেটে মাটি বহনের রাস্তা তৈরি; হুমকির মুখে বাঁধ ও বসবাসকারীরা

দেশের শস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁর প্রধান ফসল হচ্ছে ধান চাষ। অনেকটা কৃষির উপর নির্ভর করেই চলে এই অঞ্চলের সিংহ ভাগ মানুষের জীবিকার চাকা। কিন্তু মাটি খেকোদের তান্ডবে দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসলী জমির পরিমাণ। তাদের কারণে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক ও এলাকার পরিবেশ। 

এই জেলায় ফসলী জমিতে পুকুর খনন বা পুকুর সংস্কারের নামে মাটি কাটার শুরুটা অনেক আগে থেকেই। তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের পুরোটা সময়েই চলেছে অবৈধভাবে মাটির কাটার মহোৎসব। গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও এই অপকর্ম চলছে আগের মতোই। ক্ষেত্রবিশেষে এই অপতৎপরতা আরো কয়েকগুন বেড়েছে।

এবার মাটি বিক্রির জন্য খোদ সরকারি বেরি বাঁধ কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। এমনকি বাঁধের অনেকগুলো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হবে সরকারি অনুদানে চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু ফসলী জমিতে পুকুর খননের মাটি নিয়ে যাওয়া হবে, তাই প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে এই কাজ করছে তারা। আর নিরব ভ‚মিকায় আছেন স্ব স্ব দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অপরদিকে বাঁধের উপর এবং পাশে বসবাস করা বাসিন্দারা রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।

নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের হামিদপুরের আয়াপুর মৌজার চরকানাই এলাকায় প্রায় ৩০-৪০ বিঘা কৃষি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খনন করবে মাটি ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা। আর পুকুর খননের সেই মাটি বহনের জন্য শ্রীমতখালী খালের সরকারি বেরি বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় একাধিক বিএনপির ব্যক্তিরা এই কাজ করেছে বলে দাবি করেন জমির লীজগ্রহীতা। অপরদিকে বিএনপির দাবি তারা এই কাজের সাথে জড়িত না; কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বেরিবাঁধ কেটে নিজেদের ইচ্ছে মাফিক এমন অবৈধ কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এদিকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করলেও এসব বন্ধে তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। তাই কেউ কেউ প্রশাসনের জোড়ালো পদক্ষেপের অভাবের কারণেও এমনটা করার সাহস পাচ্ছে বলে মতামত প্রকাশ করেন।

স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে মাটিখেকোদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কঠোরভাবে অভিযান পরিচালনা না করার কারণে তারা ভয়কে জয় হিসেবে নিয়ে দেদারছে কেটে যাচ্ছে মাটি। আর এসব মাটি ভর্তি ট্রাক ও ট্রলির কারণে রাস্তায় বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বাতাসে উড়ে আসা ধূলায় চোখ ও শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি ছাড়াও অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সাধারণ মানুষসহ স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের প্রধান সড়ক দিয়ে চলাচল করতেও শঙ্কার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন।

মিরাটের হামিদপুরের চরকানাই এলাকার বাসিন্দা জেমস, আসলাম ও এক নারীসহ অনেকে জানান, প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম সরকারের পক্ষ থেকে বাঁধ কেটে চলাচলের জন্য রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে। পরে জানতে পারি চরকানাই এলাকার চাষের জমি ও আশেপাশের জমি লীজ নিয়ে পুকুর খনন করা হবে। সেই পুকুরের মাটি বহনে ট্রাক্টরের চলাচলের জন্য প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি বাঁধ কেটে অবৈধ ভাবে রাস্তা তৈরি করেছেন। যদি এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক্টর চলাচল করে তাহলে বাঁধের মুখে যে ব্রীজ রয়েছে সেটি চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। চলাচলের জন্য রাস্তার খুবই দরকার কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে মাটি নিয়ে ট্রাক্টর চলাচল করলে বাঁধের অনেক ক্ষতি হবে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে চলাচল করা গেলেও বর্ষা মৌসুমে তৈরি করা রাস্তা ধ্বসে যাওয়ার আশাঙ্কায় রয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে জমিগুলো লীজ নিয়েছে বলে জানান শহিদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি মুঠোফোনে বলেন, আমি শুধু জমি লীজ নিয়েছি। পুকুর কেটে দিচ্ছে বিএনপির একাধিক ব্যক্তি। তারা আমার কাছ থেকে জমির কাগজ নিয়ে গেছে। আর আমি বাঁধের রাস্তা কাটিনি। তিনি আরও বলেন, তারা ৭-৮জন মিলে এই কাজ করছে। এর মধ্যে রাণীনগর উপজেলার দুইজন ও জেলার দুইজন আয়াপুর মৌজায় দশ বছরের জন্য লীজ নেওয়া আমার ২০-২৫বিঘা জমিতে পুকুর খনন করবেন বলে জমির সকল কাগজপত্রাদি নিয়েছেন। সেই পুকুর খননের মাটি বহনের জন্য তারাই বাঁধ কেটে ট্রাক্টর চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করেছেন। সেখানে সম্ভব পানি উন্নয়নের লোকজনও উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেন তিনি। তবে শহিদ সেই বিএনপি নেতাদের নাম প্রকাশ করেননি।

ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবু জোবায়ের এর মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফইজুর রহমানের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোসারব হোসেন জানান, দেশ ও জাতির ক্ষতি হয় এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কর্মকান্ডের সঙ্গে বিএনপির এমন কোন ব্যক্তির জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া রাষ্টের ক্ষতি হয় এমন কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

রাণীনগ উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) শেখ নওশাদ হাসান মুঠোফোনে জানান, আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছি। অতি দ্রæতই বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ওই এলাকার ফসলী জমিতে পুকুর খননের কোন অনুমতি প্রদান করা হবে না বলেও জানান তিনি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print