৬০ বছরের অবির উদ্দিন তার মেয়ে শাপলাকে নিয়ে তাকিয়ে আছে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি জমির দিকে। ক্ষমতা ও টাকার কাছে বাপ-দাদার জমি হাতছাড়া হতে পারে সেই আশঙ্কায় আছেন। তবুও মেয়ে হয়ে বাবার পাশে থেকে লড়ছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। তাই বাবার চার শতক জমি উদ্ধারে বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিচ্ছে মেয়ে শাপলা।
ঘটনাটি নওগাঁর সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের দীঘির পাড় এলাকায় রামরায়পুর গ্রামে।
অভিযোগ প্রতিপক্ষরা ২৬ লিংক জমি কিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অসহায় অবির উদ্দিনের পুরো চার শতক জমিই দখল করে রেখেছে। সেসময় প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্মমভাবে মারপিটের শিকারও হয়েছিলেন পরিবারের নারী-পুরুষরা।
গত একবছরে সঠিক বিচার না পেয়ে ১২ জুলাই ৫ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী অবির উদ্দিন। মঙ্গলবার ১৫ জুলাই অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন তদন্তকারী অফিসার এএসআই মানিক।
জানা যায়, উপজেলার রামরায়পুর মৌজায় ২৪০ নং খতিয়ানে ৬১১ নং হাল দাগে ১১ শতকের কাতে অবির উদ্দিন পৈত্রিক ও কবলা সূত্রে ৪ শতক জমির মালিক।
অপরদিকে অবিরের বাবার অংশ থেকে প্রাপ্য ২৬ লিংক জমি তার মা বিক্রি করে দেয়। সেই সুবাদে একই এলাকার মৃত পিয়ার আলীর ছেলে হারুন, জমসের আলী, ইমান আলী ও হামিদুল এবং মৃত আলালের ছেলে ফারুক কিছু জমি কবলা সূত্রে পায়। কিন্তু বিবাদীগণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুরো সম্পত্তি ক্ষমতার জোরে দখল করে নেয়। এখনও তারা নিজেদের দখলে রেখে জমিতে কাজ করছে। অপরদিকে অসহায় পরিবারটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে, আর চাচ্ছে সঠিক দাবি।
সেসময় ক্ষমতার কাছে অসহায় ছিলেন জানালেন অবির উদ্দিন ও মেয়ে শাপলা। অবির উদ্দিন বলেন, সেখানে সোয়া ৪ শতক জমির মধ্যে মা তার অংশের ২৬ লিংক জমি বিক্রি করে দেয়। সেই ২৬ লিংক জমি প্রতিপক্ষরা কিনে নিয়ে পুরো জমিই দখলে নেয়। দখলে বাঁধা দিতে গেলে তারা আমাদের চরম মারপিট করে।
মেয়ে শাপলা বলেন, আমার মায়ের মাথায় ১৫-১৬ টা সেলাই, বাবার মাথায় ১৩ টা ও ছোট ভাইয়ের মাথায় ৯টা সেলাই দেওয়া আছে। অথচ টাকা ও ক্ষমতার কাছে ছিলাম অসহায়। এখনও ক্ষমতা দেখাচ্ছে। তাদের লাঠি ও টাকার জোর দুটোই আছে। আমরা অসহায় মানুষ কার কাছে যাব, কোথায় গেলে সঠিক বিচার পাবো সেটা আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ একদিন ঠিকই বিচার করবে।
স্থানীয় রানা নামের একজন জানালেন, সেদিন আমি শুধু আহতদের অবস্থা দেখে রাস্তা থেকে তুলে ভ্যানযোগে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি, তাতেই প্রতিপক্ষরা আমার নামে মিথ্যে মামলা দিয়েছে।
প্রতিবাদ করায় মামলার আসামি হয়েছি জানিয়ে স্থানীয় দুলাল মাতব্বর বলেন, তারা আমার নামেও মামলা দিয়েছে। সেখানে অবির আলী ৪ শতক জমি পাবে এটা শতভাগ সত্য। কিন্তু ফারুকেরা কাগজ দেখাতে চায়না। তারা চেয়ারম্যানের নোটিশও অমান্য করেছে। আসলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলে তারা।
পরপর ৭ বারের মেম্বার ছিলেন জানিয়ে আতাউল হক বলেন, ফারক ও জমসেররা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরীহ অবির উদ্দিনের জমিও দখল করে রেখেছে। তারা কোন কাগজ মূলে জমিটি দখল করে আছে সেটা আমাদের জানা নেই। তবে তারা কোনদিন কাগজ দেখাতে রাজি হয়নি।
তারা সকলেই জানালেন, অবির উদ্দিন পৈত্রিক সূত্রে দুই শতক এবং দুই ফুফুর আরও দুই শতক মোট ৪ শতক জমি পাবে সেখানে। অপরদিকে ওই দাগে ফারুকেরা অবির উদ্দিনের মায়ের কাছ থেকে মাত্র ২৬ লিংক (এক পোয়া) জমি কিনে নেয়। অথচ নিরীহ লোক পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুরো জমিই দখল করে নিয়েছে। এখনও দখলে রাখার জন্য শুনলাম আদালতে ১৪৪ ধারায় মামলা করেছে। এটা একটা হয়রানি করার কৌশল।
তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযোগ ওঠা জমসের আলী ও ফারুক। ফারুক বলেন, আমরা কয়েক বছর থেকে জমিটি ভোগ দখলে আছি। জমিটি অবিরের মা আমাদের কাছে বিক্রি করেছে। এছাড়া আমরা কখনও ক্ষমতার জোর দেখায়নি। সেদিন উভয় পক্ষই মারামারিতে আহত হয়েছিল। আর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নোটিশ করলে আমরা হাজির হয়ে সময় নিয়েছিলাম। আরেক দিনও গিয়েছিলাম, কিন্তু সেদিন অন্য শালিস থাকায় বসা হয়নি। এছাড়া আমাদের সকল জমির দলিল আছে। সেগুলো জমা আছে, প্রয়োজনে দেখানো যাবে। তবে এখন যেহেতু আদালতে মামলা করা হয়েছে, তাই আইনগতভাবে তারা যদি জমি পায়, তাহলে আমরা ছেড়ে দিব।
একাধিকবার নোটিশ করার পরও ফারুকেরা কাগজ দেখাতে হাজির হননি বলে জানান শৈলগাছী ইউপি চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, অবির উদ্দিনের সেখানে চার শতক জমি আছে। আমি তাদের উভয় পক্ষকে নিয়ে বসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিপক্ষ জমসের ও ফারুকেরা কাগজ নিয়ে বসতে চায়নি। শুনলাম আদালতে মামলা করেছে। তারপরও তারা যদি পরিষদে বসতে চায়, তাহলে আমি সমাধানের চেষ্টা করবো।
জানতে চাইলে সদর থানার তদন্তকারী অফিসার এএসআই মানিক মুঠোফোনে বলেন, আমি সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয় পক্ষের সাথে কথা বলবো। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
