মে ৭, ২০২৪ ১১:৫৬ এএম

বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল হলো ‘পাকা বাড়ি’/ মতামত

আগুণে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্থ বঙ্গবাজার মার্কেটের একাংশ। ছবি: শাদমান আল আরবী
আগুণে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্থ বঙ্গবাজার মার্কেটের একাংশ। ছবি: শাদমান আল আরবী

বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল হলো ‘পাকা বাড়ি’। সামর্থ্য তৈরি হলেই দেখা যায় নির্মাণ কাজ শুরু করে। সেখানে যদি গাছ-গাছালি, বন-বাদার থাকে সেগুলো উজাড় করা হবে, পুকুর, খাল, ডোবা, নদী সহ অন্যান্য জলাধারও নির্দ্বিধায় ভরাট করা হবে, আর পাহাড়-টিলা কেটে সমতল বানানো হবে ভবন তৈরির জন্য। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা প্রবন এলাকার মানুষের মজবুত ঘর ও কাঠামোর আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে ‘পাকা বাড়ি’ সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।

খুব সম্ভবত প্রকৃতির সাথে বসবাস করার ধারণা আমাদের মধ্যে নেই, এমনকি মানুষ হিসেবে নিজের নিরাপত্তার ধারণাও তৈরি হয়নি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে কিছু পড়াশোনা মনে হয় করানো হয় কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বোধ তৈরি ও চর্চার মাধ্যমে প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল যে প্রজন্ম তৈরি হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে কিনা সন্দেহ।

আমাদের মধ্যে কাঠামো নির্মাণের যে আকাঙ্ক্ষা সেটা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একই রকম মনে হয়। এ অঞ্চল নানা সময়ে নানা শাসকের অধীনে ছিল, এবং সেসকল শাসনামলে নানা ধরনের কাঠামো তৈরি হয়েছে তারমধ্যে বেশিরভাগ সম্ভবত শাসকদের প্রাসাদ এবং তাদের অফিস আদালত।

অন্যদিকে সাধারণ মানুষের যেহেতু এরকম বাড়িঘর ও কাঠামো ছিল না খুব সম্ভবত এ বিষয়গুলোও এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কাঠামো তৈরির আকাঙ্ক্ষা প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত হয়েছে। এ বিষয়টি নৃতাত্ত্বিক গবেষণার দাবি রাখে।

একদিকে চাহিদা আরেকদিকে কাঠামো নির্মাণের এই আকাঙ্ক্ষা মিটাতে গিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস করছি অবলীলায়। এই ট্রেন্ড গ্ৰাম থেকে শহর সবখানে। ফুলের সৌরভ, পাখির কলতান বাদ দিলাম, ক্লান্ত মানুষ ছায়ার নিচে বসবে শহরে গাছ নেই, পরিসংখ্যান দেখেন শহরে গাছের পরিমাণ কি রকম কমেছে।

একসময় ভূউপরিস্থ জলাধার খাবার পানির অন্যতম উৎস ছিল, সেটা ডিগ্ৰেড হওয়ায় ঘরের কাজে ব্যবহার করা যেত, আর এখন আগুন নেভানোর পানির জন্য হাহাকার!

কাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা ও নকশা তৈরির ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা বোধের অবস্থা বুঝা যায়। আমাদের বিল্ডিং কোড রয়েছে, স্থপতি- প্রকৌশলীরা বিল্ডিং কোড মেনে নকশা তৈরি করে দেন, আবার নকশা অনুমোদন ও পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

ব্যক্তি পর্যায়ে দেখা যায় নকশা একটি তৈরি করে অনুমোদন নেয়ার জন্য আরেকটি তৈরি করে বাস্তবায়নের জন্য। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও পরিদর্শন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু না বলি! বাস্তবায়নকৃত নকশায় ভূমিকম্প, অগ্নি নির্বাপন ও অন্যান্য নিরাপত্তা জনিত কম্পোনেন্টের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ মনে করে এগুলো ‘বাড়তি খরচ’, নির্মাণের সময় প্রকৌশলীকে বলা হবে এগুলো বাদ দিতে। আর যারা রাখে সেটাও অপ্রতুল, ফায়ার সেফটির আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করে দেখা যায় হোস পাইপ, ফায়ার এক্সটিংগুইশার রেখেছে।

যদিও বড় কোন অগ্নিকাণ্ডে এই ব্যবস্থা তেমন ফলপ্রসূ হয়না, ভালো কথা এগুলো রাখছেন, তো এগুলো ব্যবহার উপযোগী রাখতে হয়, চালানোর জন্য প্রশিক্ষিত জনবল লাগে, সেগুলো ঠিকঠাক নাই। কাঠামো নির্মাণের সময় প্রয়োজনীয় জায়গা ছাড়া তো দূরের কথা দেখা যায় রাস্তার দিকে ভবনটি একটু বাড়িয়ে নেবে, তো সবাই মিলে যখন এই কাজটি করে স্বাভাবিক ভাবেই রাস্তা সরু হয়ে যায়, জরুরি প্রয়োজনে এ্যমবুলেন্স, ফায়ার ট্রাক ঢুকতে পারে না। ঐ যে নিরাপত্তা বোধ নাই। আর অপরিকল্পিত ও টেম্পরারি যেসব আবাসন ও মার্কেট সেগুলো নিয়ে নিরাপত্তা জনিত আলাপই খাটে না।

কাঠামো নির্মাণে আমাদের যতটা উৎসাহ উদ্দীপনা, নির্মাণের পরে সেটার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ঠিক ততটাই গাফিলতি। এটা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একই রকম। ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে আমরা বরাদ্দ রাখতে চাইনা, রাখলেও অপ্রতুল। যেহেতু নিরাপত্তা বোধ গড়ে উঠেনি তাই কাঠামো ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ থেকে যাচ্ছে।

আবার অগ্নি নির্বাপনে আমাদের যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের কে আলাপে আনি কোন অগ্নিকাণ্ড বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে। একদিকে অনুমোদিত/ অননুমোদিত সুউচ্চ ভবন ও কাঠামোতে শহর ছেয়ে গেছে যাদের নিজস্থ অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নাই বা দুর্বল।

আরেকদিকে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা কি বাড়ছে কোন অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা বোঝা যায়। আমরা যদি তুলনা করি আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অত্যন্ত দক্ষ ও ডেডিকেটেড, যারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেও অগ্নি নির্বাপন ও উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

যারা নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নুন‌্যতম ধারণা রাখেন তারা জানেন যে নিজের নিরাপত্তা ঠিক রেখে তারপর উদ্ধার অভিযান চালাতে হয়। কিন্তু‌ যথেষ্ট আধুনিক ইক্যুইপমেন্ট ছাড়াই আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের জীবন বিপন্ন করেও কাজ করছে।

ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধির বরাদ্দ দেখলে ধারনা পাওয়া যাবে আমরা এই ধরনের নিরাপত্তা বিধানে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি।

সব মিলিয়ে ফলাফল যা হওয়ার তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

গোঁজামিল দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব না। নিরাপত্তা কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ঢাকা, বাংলাদেশ।
লেখকঃ মোঃ বায়েজীদ হাসান
প্রতিষ্ঠান প্রধান (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)
ডিএম ওয়াচ লিমিটেড (একটি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান)

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print