মে ৬, ২০২৪ ১:৪১ পিএম

হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা

হ্যাম্নি বাংলাদেশকে ভালোবাসিলা; হ্যাম্নিকের ভাষা হ্যাম্নি ধ্যারকে র‌্যাখবেই

এক শ্রেণীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভাষার নাম সাদ্রি। তাদের ছেলে-মেয়েরা নিজস্ব ভাষায় তেমন কথা বলতে পারে না। একাডেকিম বা বই পুস্তকের মাধ্যমে শেখা হয়না। তাই বাবা-মার কাছ থেকে যেটুকু শেখা, সেটাই কোনোমতে ধরে রাখার চেষ্টা। ফলে ভূলেই যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলা।

বলছি নওগাঁর বদলগাছীর উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের চারটি ছেলে মেয়ের কথা। কলেজ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর শিক্ষা ভাতা দেওয়া হয়। সেই জন্য প্রত্যয়ন নিতে এসেছিলেন উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের চকআলম পুর এলাকার অমৃত ওড়াও’র ছেলে অজিত কৃমার ওড়াও, রসুলপুর এলাকার মাধবপাড়ার কিরণ চন্দ্র মিনজীর ছেলে প্রশান্ত মিনজী, একই এলাকার বৃষ্টি তির্কী। এরা তিনজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ওড়াও সম্প্রদায়ের। আর তাদেরই সহপাঠী শ্যমপাড়ার পংকরী রাণী পাহান সম্প্রদায়ের। তবে এদের মধ্যে আরও মিল আছে, এরা সকলেই বদলগাছী বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করছে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এবং একই বিভাগ রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী তারা।

প্রত্যয়নের জন্য আবেদন জমা দিতে এসেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে। সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র মন্ডল আন্তরিকতার সহিত তাদের আবেদনের ভূলভ্রান্তি বুঝিয়ে দিয়ে ঠিক করে জমা দিতে বললেন।

সেখানে তাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। একাডেকিম বা বই পুস্তকের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ভাষা শিখতে পারছে কিনা। স্কুল কলেজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের জন্য আলাদা কোনো ভাষার ব্যবস্থা আছে কিনা। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুরই ব্যবস্থা নেই। তাই তারা ভূলে যেতে বসেছে তাদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষা। তবে জন্মের পর বাবা-মার কাছ থেকে যেটুকু শেখা যায়। তাও ঠিক মতো আর বলতে পারে না। আমি বা আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি এই বাক্যটি তাদের নিজস্ব ভাষায় জানতে চাওয়া হয়। আমতা আমতা করে অজিত কুমার ওড়াও এবং প্রশান্ত মিনজী বললো হ্যাম বা হ্যাম্নি বাংলাদেশকে ভালোবাসিলা। আর ঝটপট বললো বৃষ্টি তির্কী। তারা সকলেই জানালেন তাদের এই সাদ্রি ভাষা কিছুটা হিন্দি ভাষার আদলে।

অজিত ও প্রশান্ত জানালেন, আমরা গত বছরও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৫হাজার করে টাকা পেয়েছি। তাই এবারও আবেদন করছি। ওই টাকাটা পেলে আমাদের অনেক কাজে দেয়। এই জন্য হ্যাম্নি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাইলা। পরিশেষে তারা চারজনই তাদের নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার আহবান জানান। তাই তারা বললেন, হ্যাম্নিকের ভাষা হ্যাম্নি ধ্যারকে র‌্যাখবেই।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র মন্ডল জানালেন, প্রত্যয়নে একটু ভূল থাকলে তাদের জন্যই পরবর্তীতে সমস্যা হবে। তাই ভূলভ্রান্তি ঠিক করে জমা দিতে বললাম। তারা জমা দেওয়া মাত্রই তাদেরকে ইউএনও স্যারের স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন দেওয়া হবে। তিনিও শুনছিলেন তাদের নিজস্ব সাদ্রি ভাষায় কথা বলা। সুবল জানালেন, তাদের ভাষাটা ধরে রাখা উচিত। সেটা যেকোনো উপায়ে হতে পারে। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও পাচ্ছেন সুযোগ সুবিধা। আমি চাই তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারুক।

বদলগাছী আদিবাসী সামাজিক সংগঠনের সহকারি সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন পাহান ও সভাপতি বিজয় পাহান বলেন, ওড়াও, পাহান, মাহাদীসহ এই উপজেলায় প্রায় ২৫হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী) আছি। অন্যদের মতো আমাদের এই সাদ্রি ভাষার প্রচলন হওয়া উচিত। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা সাদ্রি ভাষায় শিক্ষা নিক। সরকার নাকি এটা নিয়ে কাজ করছে। আমরা শুনেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে সাদ্রি ভাষার জন্য বই দিবে। প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বই থাকবে। দেওয়া হবে শিক্ষা। আমরা চাই প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের আলাদা একজন শিক্ষক থাকবে, তারাই আমাদের এই সাদ্রি ভাষাটা ছেলে-মেয়েদের পাঠদান করাবে। আর এটা দ্রুত কার্যকর করা হোক। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি খুশি। তাই তারাও জানালেন হ্যাম্নি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাইলা।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা অজানা কাহিনী ও ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে নিয়ে আসা সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক এম এম রাসেল বলেন, তাদের সাদ্রি ভাষা সংরক্ষণ করা দায়িত্ব। সেটা যেকোনো উপায়ে হতে পারে। আমার জানামতে এই ভাষাটি ভারতের ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা থেকে এই সাদ্রি ভাষা এসেছে। এছাড়া বাংলাদেশের চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আদিবাসীরা কাজ করতো। সেখানে এই ভাষাটি প্রচলন হতো। এদেরই একটা অংশ হয়তো এখানে এসেছে। বা বংশ পরক্রমায় আছে। সাদ্রি ভাষা ওড়াও সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ভাষা করে নিয়েছে। তাই তাদের পড়াশোনার জন্য নিজস্ব ভাষার বইও থাকা দরকার।

জানতে চাইলে নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্যও তিনি অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশে আমি আমার এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জীবন মান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এবং ভবিষ্যতেও কাজ করে যাবো।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print